সোমবার, ফেব্রুয়ারী ০৩, ২০২৫

ট্রাম্পের ট্যারিফ

 নাফটা চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডা, মেক্সিকোর সাথে ট্রেড-ওয়ার শুরু করল। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে জমে ওঠা মুক্ত বাজার অর্থনীতির, যার জন্য প্রায় সব দেশেই প্রভুত উন্নতি সাধন হয়, অপমৃত্যু হল ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে।

১৭৭৬ সালে এডাম স্মিথ মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা প্রস্তাব করেন। তার মতে, দক্ষ এবং সাশ্রয়ী শ্রমিকরা তৈরি করবে পণ্য, তা তারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন। সেই পণ্য জটিল এক সাপ্লাই-চেইনের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছবে। উপকৃত হবে প্রতিটি দেশ। মার্কেট ইকনোমির অর্থ হচ্ছে পণ্যের সাপ্লাই-ডিমান্ডে সরকারের নাক না গলানো এবং পণ্য যাতে ফ্রি-ফ্লো হয় তাতে সহায়তা করা। এর প্রথম শর্ত অযথা ট্যারিফ তুলে দেয়া।
বলশেভিক বিপ্লবের পরে কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর বড় একটি অংশ মার্কসিও অর্থনীতির বাস্তব-প্রকাশ প্লানড ইকোনোমিক্স চর্চা করে, যেখানে রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে দেশে কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদিত হবে, সেটিও টেকশই হয়নি, বাহ্যত কমিউনিস্ট দেশগুলো মিশ্র ধনতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে, কোনটি আবার অকাট্য শ্বৈরতান্ত্রিক দেশে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গেছে, দুই জার্মানি জোড়া লেগেছে। ভবিষ্যতে দুই-কোরিয়া যুক্ত হলেও আশ্চর্য হব না।
একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ফেরত এক ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাই, রাশিয়া দেশটি সম্পর্কে আমার অনেক কৌতুহল, বিশেষ করে তাদের রাস্তায় কোন ধরণের গাড়ি চলে, বাসায় কোন কোম্পানির ফ্রিজ, সেগুলো কি সোভিয়েতে তৈরি নাকি অন্য কোন দেশের? উত্তরে সেই ভাই বলেছিল, ওখানকার ফ্রিজগুলোর ওজন অনেক বেশি, জীবনেও নষ্ট হয়না, টেকে শতবছর। সেই উত্তর শুনে আমার মনে হয়েছিল, তাহলে ফ্রিজ কোম্পানিগুলো তো নতুন ফ্রিজ বানাতে পারবে না, কারণ কারও বাসার ফ্রিজ সহজে নষ্ট হচ্ছে না, তার মানে কোম্পানিগুলো উঠে যাবে, যার অর্থ হচ্ছে লোকে চাকরি হারাবে। বিষয়টি তুচ্ছ হলেও এর একটা গুঢ় অর্থ আছে। সমাজে টাকার প্রবাহ বহমান থাকা জরুরি, যেই দেশে মানুষ তার ইনকামের বড় একটা অংশ ব্যয় করবে পণ্য কেনায়, সেখানে ইন্ড্রাস্টি বিকশিত হবে লোকে চাকরি পাবে, এবং সর্বপরি মানুষ ভাল থাকবে। ভারতবর্ষে লোকে আগে সিন্দুকে টাকা জমাতো, ব্যংক ছিল না। ব্যাংক থাকলে যেটি সুবিধা, অন্য লোক আপনার জমাকৃত টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে এবং লোকে সেখানে চাকরি পাবে। অবশ্য কোনো দেশে সুফি দরবেশ বাবার মত দুষ্ট শক্তির আবির্ভাব হলে এবং ব্যাংকগুলো লুটে নিলে আম-ছালা দুটোই যাবে।
এবার বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আসি। না, ওনার সমালোচনা করছি না। ওনার লেখা বইগুলো আমি যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি। প্রত্যেকটা বই দারুণ উপভোগ্য। তো 'আমার দেখা নয়াচিন' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- চিনে গিয়ে সেভ করার জন্য যে ব্লেডগুলো দেশ থেকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন তা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। উনি বাজারে গেলেন ব্লেড কেনার প্রত্যাশায়, সমস্ত দোকান খুঁজে কোথাও ব্লেড পেলেন না। শেষে এক দোকানে তিন-চার বছরের পুরোনো একটা জংধরা ব্লেড পেলেন। দোকানদার বলল, বিদেশ থেকে এইসব জিনিস আমরা আনি না। এমনিতেই আমাদের দাঁড়ি কম, যে দু'চারটে ছাগলি দাঁড়ি আছে তা আমরা নিজেদের দেশে তৈরি ক্ষুর দিয়েই শেভ করি। আমরা বিদেশকে কেন টাকা দিব? পাঠক লক্ষ্য করে দেখেন সেই দোকানদার এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথার ধরণ সেম সেম। ট্রাম্প বলেছেন, কানাডা এবং মেক্সিকো তাদের তৈরি জিনিস বিক্রি করে আমাদেরকে এতদিন শোষণ করেছে, এখন এর একটা বিহিত করা দরকার। বঙ্গবন্ধুর ব্লেড কেনার অভিজ্ঞতার অনেক বড় একটা তাৎপর্য আছে- সেটি হলো দেশে ব্যবহৃত জিনিস দেশেই তৈরি হবে- শুধু তাই নয় সমাজতান্ত্রিক দেশের ধারা অনুযায়ী সেগুলো রাস্ট্রই তৈরি করবে। তাইতো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি পাকিস্তানি ব্যবসায়ির ফেলে রাখা ৭২৫ টি কলকারখানার বড়গুলোকে রাস্ট্রায়াত্ব করে ফেললেন- এবং তারপর সেখানে আওয়ামীলীগের লোকদের যে মাৎস্যন্যায়- সেটি নিয়ে না'হয় আরেকদিন লিখব।
মোটকথা, দেশের জিনিস দেশেই তৈরি করব বলে যে একধরণের অবুঝ জাতীয়তাবাদের চেতনা - তা মুলত বাজে কথা। বরং অন্য দেশের জন্যও আমরা পণ্য তৈরি করব বললে বিষয়টি যথাযথ হয়। সাপ্লাই-ডিমান্ড যেমন ন্যাচারাল, বৈশ্বিক সাপ্লাই-চেইন তেমনি ন্যাচারাল- অর্থ্যাৎ মুক্ত বাজার অর্থনীতি। এটাই শেষ কথা হওয়া উচিত। যে চিন ঘুরে এসে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন তাদের সমাজতান্ত্রিকতা দেখে, যে চিনকে ধ্যানে- জ্ঞ্যানে-হৃদয়ে ধারণ করে মাওলানা ভাসানী বড় কিছু করতে চেয়েও পারলেন না, সেই চিন কিন্তু সত্তরের দশক থেকেই মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে যাব যাব করছিল, এবং যখন গেল তখনই তরতর করে উন্নতির শিখরে অবতরণ করতে শুরু করল। ভারতের দিকে তাকান, এমনকি বাংলাদেশে, কোন দেশে নয় ? নব্বুই দশকের পর থেকে বাজার যখন উন্মুক্ত হল- দেশগুলো উন্নতি সাধন করতে থাকল।
যে ট্রাম্প এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির কফিনে প্রথম পেরেক মারতে চাইছেন- তাদের একজন ফাউন্ডিং ফাদার- তাদের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন - প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে খুব যত্ন করে একটি বই পড়েছিলেন- এডাম স্মিথের 'ওয়েলথ অফ নেশন'- বইটি মুক্তবাজার অর্থনীতির আকরগ্রন্থ। অথচ আজ দুশো বছর পরে এসে নিজের পণ্য নিজের দেশেই উৎপন্ন করব বলা ট্রাম্পের, ট্যারিফ ইমপোজ করার ট্রাম্পের, আসল উদ্দেশ্যখানা হয়ত আমরা এখন বুঝতে পারছি না, তবে শীঘ্র পারব।
ক্যালগেরি
৩/২/২০২৫ ইং
All reactions:
Md Mostaba Ali, Wahedul Islam Patowary Raju and 19 others
4 comments
1 share
Like
Comment
Send
Share

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন