পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন দল ইংল্যান্ডের দি টোরিজ, আর সবচেয়ে নবীন দল যেটা আজকে গঠিত হবে- জাতীয় নাগরিক পার্টি সংক্ষেপে এনসিপি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দলকে শুভকামনা।
অনেকদিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল, এখন ঠিক করেছে দল গঠন করবে। ৯০'এর গণ অভ্যুত্থানের ধরন ও প্রেক্ষিত আলাদা ছিল। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোই বিশেষত তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। তিন-জোটের-রূপরেখা নামে একটা চার্টার ছিল , স্বৈরাচার পতনের পরে কী কী করা হবে সেই বিষয়ে। সেই চার্টারে ভরসা রেখে আমরা জনগণ স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, সকল অশুভ শক্তি দেশ থেকে বুঝি পরাভূত হয়ে গেল। কিন্তু হায়। ৪৭ থেকে ৯০ কম পথ তো নয়, এরমধ্যে সামরিক-বেসমরিক মিলে কত নাটক মঞ্চায়িত হলো এই পোড়া দেশে। মানুষের মুক্তি আর হইল না।
দলও গঠন হয়েছে বিস্তর , প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। একেক দলের একেক রকম ভাবাদর্শ। ভাবাদর্শগুলো অবশ্য নামকাওয়াস্তে। যে দল ( যেমন জাসদ ইনু) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কায়েম করবে, সে কিনা একটা মন্ত্রীত্ব কিংবা এমপি পদের জন্য হাসিনার পা ধরে। বাসদ নামের দলটি- যারা বিপ্লবের পক্ষে কিন্তু ভোটের বিপক্ষে, তারাও দেখি হাসিনার জোটে শরীক হয়ে ভোট করে। মুখে সবাই সাম্য এবং মৈত্রির কথা বলে, বাস্তবে ব্যস্ত থাকে হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিতে। বাম-ডান মিলে অসংখ্য দল তৈরি হয়েছে, আবার বিলীন হয়ে গেছে। যে মুসলিমলীগ পাকিস্তান তৈরি করেছিল, তারা ৫৪'র নির্বাচনে ২৩৭ এর মধ্যে ৯ টো আসন পায়।
বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দল তৈরি হয়। কখনও মহান লক্ষ্য নিয়ে, কখনও খুচড়া কারণে। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার অব্যবহিত পরেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য প্রকট হওয়ায় সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, মুজিব মিলে আওয়ামীলীগ তৈরি করে। মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করাই সমীচীন মনে করেন তারা। এতে অবশ্য একটা লাভ হয়। রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটে। মুসলিম লীগ থাকলে আমাদের আর "সাধের লাউ" গান গাওয়া লাগত না। মনে নেই ১৯৬৭ সালে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করা হয়। আসলে পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতি আর পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি কোনমতেই এক নয়। পাকিস্তানিরা মিডল-ইস্টের আরও নিকটে, আরবদের মত তাদের নাক লম্বা, তারা পোলাওয়ে গোলাপজল দেয়, রাইতা দিয়ে কাবাব খায়, গজল শোনে ও সপ্তাহে একদিন গোসল করে। অন্যদিকে আমরা শীতের মধ্যেও প্রতিদিন পুকুরে ডুব দেই, ছোট মাছের চচ্চরি খাই, পান্তাভাত লাগেই, শীতে পিঠাপুলি,একতারায় বাউলের গান। কাজেই দেশ স্বাধীন হবেই এবং হয়েছেও। ষাটের দশক উত্তাল রেখেছে আওয়ামীলীগ, মেজর বামপন্থী দল, আওয়ামীলীগ থেকে সড়ে আসা ন্যাপ মিলে। সেই সময়ে কিউবা, ভিয়েতনাম, চীন এবং সর্বপরি নকশাল আন্দোলনের প্রভাবে প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তির ভালই উদ্ভব ঘটে।
স্বাধীনতার পরে বিশাল ধাক্কা খায় দেশ। আমলাদের অসহযোগিতা, আওয়ামীলীগের দেশ চালাতে অদক্ষতা, অনেকের অস্ত্র জমা না দেয়া, লুটপাট, কারখানার যন্ত্রাংশ বিক্রি, ব্যাংকের ভল্ট খালি করা ইত্যকার নানা সমস্যায় জর্জরিত হয় দেশ। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান-ফেরতদের বৈরিতা শুরু হয়। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী শসস্ত্র অভ্যুত্থানের বাসনা এবং প্রস্তুতি চলে। লীগের একটা অংশ ছিটকে গিয়ে জাসদ গঠন এবং আওয়ামীলীগকে দৌঁড়ের উপর রাখে। অন্যদিকে সিরাজ শিকদার শ্রেণিশত্রু খতম করতে শুরু করে। সাতকোটি লোকের জন্য আটকোটি কম্বল আসলেও সব কম্বল পরিশেষে চুরি হয়ে যায়, সবমিলিয়ে হজপজ একটা অবস্থা। ফলশ্রুতিতে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ নামে। এই অবস্থায় কে বা কারা বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল গঠন করার পরামর্শ দেয় অথবা তার নিজের মাথায় আসে আইডিয়াটা - ইতিহাসের চরম একটা ভুল। বাকশাল এমনিতেই থাকত না কারণ বিষয়টা ন্যাচারাল নয়। মাঝখানে পুরো পরিবার শেষ।
তারপর বিএনপির জন্ম। আমি অবশ্য ছোটদলগুলোর জন্মের কথাও বলতে চাই, কিন্তু পোস্ট বড় হবে বিধায় সম্ভব নয় যেমন দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দল, মনে আছে দিলীপ বড়ুয়াকে ? ঐ যে বক্তব্য দিতে গিয়ে পায়জামা খুলে পড়ে গিয়েছিল। কিংবা কল্যান পার্টির কথা মনে আছে? মোছওয়ালা ঈব্রাহিম সাহেব, বিট্রে করে ২৪ এর নির্বাচনে গিয়েছিল। কিংবা অলি আহমেদের এলডিপি, অথবা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা, ডঃ কামালের গণফোরাম, এমনকি যে দরবেশবাবা জেলে, সেও একটা দল করেছিল স্ব-নির্ভর বাংলাদেশ বলে, মাছমার্কা প্রতীকে নির্বাচনও করেছিল।
যাইহোক বিএনপির কথা বলছিলাম। যেখানে বড় দল ভেঙ্গে টুকরা হয়ে ছোট দলের সৃষ্টি হয়, সেখানে নানা মতের নানা পথের মানুষ ধরে নিয়ে এসে একটি দল গঠন করা দুরূহ বিষয় হলেও জিয়া সেটি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে করতে পেরেছিলেন। সাথে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন। মোটকথা বাকশাল বাতিল হয়ে আগের অবস্থা জারি হয়েছে আবার। সাধারণ মানুষ জিয়ার সাথে ছিল। ক্যাপ মাথায় দিয়ে, একটা রে-বেন সানগ্লাস পরে ছাদখোলা জিপ গাড়িতে চড়ে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তাকেও মেরে ফেলা হয়। সারা দেশের মানুষ কেঁদেছিল সেদিন। আমি ছোট ক্লাশে ছিলাম, খবর শুনেই স্কুল ছুটি দেয়, স্কুল থেকে হেঁটে যখন বাড়ি আসছিলাম, চারপাশে দেখছিলাম সবকিছুই স্তব্ধ।
এরপরে আসে জাতীয় পার্টি। এরশাদ অনেক দোষে দোষী হলেও, নয়বছর কিন্তু গদিতে টিকে ছিল। ভারতের আশীর্বাদপুষ্টে নাকি স্বীয়-যোগ্যতায় তা অবশ্য বলতে পারব না, তবে নয় বছরে ভারতকে চটিয়ে কিছুই করেনি। অবকাঠামো বিশেষ করে রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়,উপজেলা তৈরি হয়। দোষে-গুণের এরশাদের দোষের পাল্লাই ভারী ছিল। নারীদোষ, কবিতাচুরি, এবং কথা-না-রাখার বিষয়ে বিখ্যাত ছিল। কীভাবে ভোট-ডাকাতি করত নিজের চোখেই দেখেছি। দিনে দিনে স্বৈরাচার হয়ে ওঠে সে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দেয়। অবশেষে পতন এবং জেল। পালাতে পারেনি কিংবা চায়নি বিষয়টা ঠিক জানা নেই। তবে রংপুরের মানুষের সিমপ্যাথি ছিল তার প্রতি অযথাই। জেলে থেকে ভোট করেও ৩৫ আসন পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। একটা ভাল দল হতে পারত,
দলটাকে নষ্ট করেছে তার ভাই কাদের এবং স্ত্রী রওশন। গত পনের বছরে জাতীয় পার্টি যদি বিন্দুমাত্র কোমড় সোজা করে থাকতে পারত, হাসিনার পক্ষে এতবড় ফ্যাসিস্ট হওয়া সম্ভব ছিল না।
এখন মাঠ ফাঁকা । বিএনপির বিরুদ্ধে একটা মানসম্পন্ন বিরোধীদল খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। অনেকে জামাতের কথা বলছে। ৯৬ সনের কথা ভাবুন, জামাত একা নির্বাচন করে ৩ টি আসন পেয়েছিল। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামাতের সিট বাড়বে কিনা জানিনা, বাড়লে আর কত বাড়বে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দল আগামী নির্বাচনে কেমন রেজাল্ট করবে জানি না। কর্মী সংগ্রহ আছে, দল গোছানো আছে, তা ছাড়া আওয়ামীলীগ যদি নির্বাচন করতে না পারে, তাহলে আওয়ামীলীগের সমর্থক আর যাকে ভোট দিক মরে গেলেও ছাত্রদের দলকে ভোট দিবে না। ছাত্রদের উপর দুনিয়ার রাগ জমা হয়ে আছে তাদের অন্তরে। নতুন দলের ভোট আসবে নন-আওয়ামীলীগদের থেকেই। তবে প্রথম নির্বাচনটা তো বড় কথা নয়। যারা হাসিনার মত দানবকে ৩৬ দিনে টেনে নামিয়েছে তাদের মধ্যে পটেনশিয়াল আছে। একতা বজায় রাখলে আগামীতে তারা ভাল করবেই। তাদের দল গঠনের প্রেক্ষিত অন্য অনেক দলের চেয়ে অনেকাংশে জোড়াল। ছোটখাটো ভুল হবে, বড়সড় ভুল হবে, অনেকেই পথচ্যুত হবে, অনেকেই পথে ফিরে আসবে, এভাবেই দিনে দিনে মহিরুহু বৃক্ষে পরিণত হবে।
ক্যালগেরি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন