সোমবার, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০২৫

আমার জন্মদিন ও থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র


ভাবছেন, এ দুটোর মধ্যে আবার সম্পর্ক কী? একটু পরেই ব্যাখ্যা করছি। প্রথমত আজ আমার জন্মদিন, মনে ছিল না। যেহেতু ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম ফ্রেমওয়ার্কের অধীন, আমার তথাকথিত অফিস থেকে সতীর্থদের ডিজিটাল উইশ আশা শুরু করল অবিরাম গতিতে। কাহাতক আর ভুলে থাকা যায় ? এনিওয়ে, হ্যাপি বার্থ-ডে টু মি।
জন্মদিন নিয়ে আমার ব্যতিব্যস্ত হওয়া কী মানায়? তিনকুল তো পার হয়ে গেল। মেয়েরা স্কুল থেকে এসে চুপ করে হাতেলেখা কার্ড বানাবে, এটা বলে দেয়া যায়, এটুকু ফর-গ্রান্টেড, প্রকৃতি বাপদের-প্রতি-মেয়েদের ভালবাসা এভাবেই ডিজাইন করে রেখেছে। কেক-টেক কাটা হবে কিনা এখনো বলতে পারছি না। যদি কেক আনা হয়, কাটব, অসুবিধা কী?
হ্যাঁ ফিজিক্সের কঠিন সূত্রটির বিষয়ে আসি। সত্য ঘটনা। আমি তখন ফোরে পড়ি। আব্বার সাথে বাজারে যাই। অনেকদূর হেঁটে গোশালা বাজারে যেতে হয়। একজায়গায় ইটের ভাটা ছিল, রাস্তার বামপাশে। অন্যপাশে আবুল এমপির বাঁশের ঝার এবং একটি কাকচক্ষু জলের দীঘি। সেই জায়গাটায় এসে আব্বাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আব্বা আমার জন্মদিন কবে? আব্বা সঠিক জবাব দিতে পারে নাই, কারণ যেই ডায়েরিতে তারিখটা লেখা ছিল তা কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে ? আব্বা বলেছিল, তাতে কী? আসলে জন্মদিন বিষয়ে কোন ব্যাপার থাকার কথা নয়। কারণ আমরা যে বছর হিসাব করি তা পুরোপুরি আপেক্ষিক একটি বিষয়। আমাদের গ্রহ ৩৬৫ দিনে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। প্রতিটি জন্মের ৩৬৫ দিন পরে যা ঘটবে তা হচ্ছে একই রকম আবহাওয়া পাওয়া যাবে, কারণ পৃথিবী সূর্য থেকে একই রকম দূরত্বে অবস্থান করবে। সময় হচ্ছে পরিপূর্ণ আলাদা একটা জিনিস। এটা ফিরে আসে না, কোনদিনও নয়। আব্বা যেটা বলতে চেয়েছিল, সময় পরম, এর যাত্রা কোন একসময় শুরু হয়েছিল, কোন একসময় হয়ত শেষ হবে।
এখানে বলে রাখি, আব্বা ছিল আর্টসের ছাত্র। অথচ সময় নিয়ে তার ব্যাখ্যা প্রায় পুরোপুরি ঠিক। সময় এবং স্থান সৃষ্টি হয়েছিল ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং থেকে। তার আগে কিছু ছিল না। সময় একটি নদীর মত, একদিকে প্রবাহিত হয়। সময়কে খুব সহজ বিষয় মনে হলেও একে সংজ্ঞায়িত করা ছিল খুব কঠিন। ইংল্যান্ডে যখন বাষ্প-ইঞ্জিন আবিষ্কার হয় তখন একটা সমস্যা দেখা দিল। সেটা হচ্ছে প্রচুর কয়লা চুলায় ঢালতে হচ্ছে টারবাইন ঘুরানোর জন্য। আমরা ছোটবেলায় এটি দেখেছি লালমনিরহাটে। তখন কয়লার ইঞ্জিন ছিল, ইঞ্জিন রুমে দুজন খালাসি লুঙ্গি মালকোচা করে সর্বদা বেলচি দিয়ে চুলায় কয়লা ঢালত। তবেই স্টিম তৈরি হত এবং ট্রেন চলত। এই বাষ্পীয় ইঞ্জিন ছিল খুবই আনএফিসিয়েন্ট। যে হারে কয়লা ঢালা হত চুলায়, বাষ্পও উৎপাদিত হত ভালই, কিন্তু কোন এক চোরাকারণে পুরো বাষ্পকে কাজে লাগানো যেত না। বেশিরভাগ বাষ্প লিক হয়ে যেত। এই বিষয় নিয়ে সেই সময়কার বিজ্ঞানীরা মাথা চুলকিয়েছে অনেক, কেন এমন হচ্ছে? এবং পরিশেষে তা ব্যাখ্যা করা গিয়েছে থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র দিয়ে। সেই সূত্র কিন্তু খুব কঠিন। আমি বুয়েটে দুটো সাবজেক্ট পড়েছি থার্মোডাইনামিক্সে উপর, তবুও এখনো বিষয়টাকে ঝাপসা লাগে। কাজেই সেটার ব্যাখ্যা শুনলে সম্মানিত পাঠকরা পালাবে। তবুও সহজতর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছি।
থার্মোডানামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র থেকে একটি বিষয় এসেছে যার নাম এনট্রপি। এটি এমন এক জিনিস যার মান শুধু বাড়তেই থাকে। মানে এখনো বাড়ছে। সৃষ্টির শুরুতে হয়ত জিরো দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তারপর প্রতিদিন বাড়ছে , এমনকি প্রতি মূহুর্তেই বেড়ে চলেছে। এনট্রপি তখনই বাড়বে যখন অর্ডার (শৃঙ্খল) থেকে ডিসঅর্ডার (বিশৃঙ্খল) অবস্থায় পৃথিবী যাবে (আসলে পুরো বিশ্ব যাবে)। তারমানে হচ্ছে আমরা প্রতিটি দিনে, প্রতিটি মুহুর্তে শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সৃষ্টির শুরুতে পুরো বিশ্ব সবচেয়ে সুশৃংখল ছিল। তারপর প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খল হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। আপনার হাতে একটি কাঁচের গ্লাস আছে। অসতর্কতা বশত সেটি মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে খানখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এটি হচ্ছে শৃঙ্খল থেকে বিশৃঙ্খল হওয়ার পকৃষ্ট উদাহরণ, অর্থ্যাৎ ছোট পরিসরে এনট্রপি বাড়ল। কোন অবস্থাতেই কিন্তু কাঁচের টুকরোগুলো উল্টোদিকে গিয়ে জোড়া লাগবে না, যদি লাগত তাহলে সময় উল্টোদিকে যাত্রা করতে পারত, এনট্রপি বাড়ার পরিবর্তে কমতেও পারত। কিন্তু সেটি হয়না। কাজেই সময়ের সঠিক সংজ্ঞা এখন আমরা দিতেই পারি। সময় হচ্ছে প্রতিনিয়ত এনট্রপি বাড়া, সেকেন্ড-ল-অফ-থার্মোডাইনামিক্স। এই বিশ্ব প্রতিনিয়ত শৃঙ্খল থেকে বিশৃঙ্খল হবে, সেটাই সময়। একটি সুন্দর শহর একসময় ধ্বংস হবে, আমাদের এই পৃথিবীও একসময় ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, কারণ সূযের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে (হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি বন্ধ হলে) আইনস্টাইনে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সূর্যকে টেক-ওভার করবে। সাদা বামনে পরিণত হওয়ার আগে সূর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে আমাদের পৃথিবীসহ সবগ্রহকে খেয়ে ফেলবে। আমরা থাকব সূর্যের পেটের ভিতর। তারপর একসময় সাদা বামন হবে সূর্য। তারপর একসময় কালো বামন, তারপর ব্লাক হোল। সব নক্ষত্রের পরিণতি তাই-ই। ব্লাকহোলগুলো একসময় শক্তি বিকিরণ করতে করতে শেষ হয়ে যাবে। তারপর এই বিশ্বের কোথাও এক কণা শক্তিও অবশিষ্ট থাকবে না। বিশ্ব হবে নিথর বিরানভূমি, হুমাউন আহমদের নাটক কোথাও-কেউ-নেইয়ের মত, ফিজিক্সের ভাষায় একে বলে হিট-ডেথ। সব শেষ। এনট্রপি আর বাড়বে না। থমকে যাবে সময়।
কাজে কাজেই, বার্থডে ফিরে আসে না বৎস, সময়ের তীর একদিকেই ছোটে। যে মাহেন্দ্রক্ষণে আমি জন্মেছিলাম, সেই ক্ষণ আর আসবে না। বরং বলতে পারি আমি ২৫ ফেব্রুয়ারি তিস্তার বসুনিয়া বাড়িতে জন্মেছিলাম, সেইদিনটা ছিল শীত শীত। আজকেও একই রকম আবহাওয়া। এতটুকুই।
ক্যালগেরি
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ইং

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন