আমাদের ভাষা আমাদের মাটির মতই প্রাচীন। তবে পৃথিবী যেমন বিবর্তিত হয়, সমাজ যেমন বিবর্তিত হয়, তেমনি ভাষাও। বিজ্ঞজনের মতে পাল আমল থেকে প্রাচীন বাংলার উৎপত্তি। তার আগে যা ছিল তা আর্যদের নিজস্ব, তাতে হয়ত দ্রাবিড়, কোলের মত অনার্য ভাষার উপাদান কিঞ্চিৎ মিশেল থাকতে পারে, তবে তা বাংলা নয় । পাল বংশ শুধু আদি বাংলার বিকাশ ঘটায়নি, এ যুগে শুরু হয়েছে সাহিত্য রচনা, তবে তা পদাবলীর আদলে। আর আমাদের ভাষার প্রসাদগুণ এখান থেকেই শুরু। সেটা নিয়েই এই পোস্ট।
আমরা অনেক সময় বলি, ছেলেটি/মেয়েটি/লোকটি সুন্দর করে কথা বলে। বা অমুখ লেখক সুন্দর লেখে। অর্থ্যাৎ তারা শব্দগুলোকে কাব্যিকভাবে বিন্যাস করে, যা শ্রতিমধুর ব্যঞ্জন সৃষ্টি করে, শুনে কানের আরাম হয়, চিত্ত উদ্বেলিত হয়। একটি বাক্য ধরা যাক, বাইরে খুব বাতাস উঠছে, একে আর কীভাবে বলা যায়? তীব্র বাতাস বইছে চারিধারে? অথবা বাতাস উঠেছে হাটুভাঙ্গা সিংহের মতন। তেমনি, কিছু মানুষ বাগান থেকে গোলাপ তুলছে, কবিরা বলবে- বাগানে গোলাপ তোলার উৎসব। কেউ অভিমান করেছে- কবিরা বলবে বুক জুড়ে আছে অভিমানের বাষ্প।
বলছিলাম প্রাচীন বাংলার পদাবলীর কথা। চর্যাপদের কথাই ধরা যাক। একটি পদ আছে এমন- দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামায়? মানে হচ্ছে গরুর বাট থেকে বের হওয়া দুধ কি আবার ফিরিয়ে নেয়া যাবে? আমরা যেমন বলি, টুথপেস্ট টিউব থেকে বের হলে তা আর ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, অথবা যে গুলি ছোড়া হয়েছে তা ফেরত নেয়ার উপায় নেই। গরুর বাট বিষয়টিতে নান্দনিকতা হয়ত নেই, তবে এটা চর্যাপদের একটি পদ বিধায় এর গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না। আগেকার আমলের কবিরা উপমা দিতে এরকম প্রাণীকুলের উল্লেখ করতেন। মধ্যযুগের কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর মাতৃস্নেহের উপমা দিতে গিয়ে বলেছেন - পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত। পিঁপড়া কামর দিবে বলে মা তার সন্তানকে মাটিতে শুইতে দেয় নাই- এরূপ মাতৃস্নেহ।
এরপর যখন আধুনিক যুগ শুরু হলো। কবিদের লেখায় ধীরে কিন্তু নিশ্চিন্তে নান্দনিকতার সৃজন হলো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কী পাও ? তারই রথ নিত্যই উধাও। বাংলায় তৎসম তদ্ভব মিলিয়ে বিশাল শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলোই পারমুটিশন কম্বিনেশন করে সৃজনশীল রূপ দিতে হবে কবিতায়, গল্পে। লেখক এখানে স্বাধীন। কোন নিয়ম নেই। গানে যেমন সি-কর্ডের পরে এ-মাইনর কর্ড না দিলে অন্যায় হবে। কবিতায়, গল্পে, গদ্যে সেই নিয়মের বালাই নেই। রবি ঠাকুরের গুরুগম্ভীর কবিতার চরণ বাদ দিলেও - অতি সাধারণ যে প্রাকৃতজনের বাংলা, সেখানেও শব্দের সুচারুবিন্যাস ঘটিয়ে অতি নান্দনিক পদ সৃষ্টি করা যায়, করেছেনও তাই। রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে লিখেছেন- রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ মিথ্যে নয়। একটাও ভারি শব্দ নেই, কিন্তু শুনতে কী দারুণ - আর তার গুঢ় ভাবার্থের কথা কী বলব?
শব্দ নিয়ে খেলায় সবার চেয়ে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে আছেন আমদের জীবনানন্দ দাশ। কী কথা তাহার সাথে তার সাথে ? একটি সর্বনাম পদের সাধু ও চলিত রূপ ব্যবহার করে কী অসাধারণ একটি বাক্য গঠন করলেন। আরেকটি পদের কথা ধরুন। সেখানে মৃত্যুকে ঘুমের সাথে তুলনা করেছেন কবি - এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি! রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি। উকিল মুন্সীও অবশ্য মৃত্যুকে ঘুমের সাথে তুলনা করে লিখেছেন - সোয়া চাঁন পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি? উকিল মুন্সির মত সুফিবাদী কবিয়ালরাও সেই মধ্যযুগ থেকেই শব্দ নিয়ে খেলছেন। শব্দকে বিন্যাস করছেন সহজীয়া উপায়ে।
গদ্য এসেছে অনেক পরে। ১৮শ শতকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথমবারের মতো গদ্য-ভাষার কার্যকর ব্যবহার শুরু হয়। সাধু ও চলিতের দোলাচলে অনেকদিন চলে শেষ পর্যন্ত চলিত কালের যাত্রায় টিকে আছে। আমরা আধুনিক গদ্য পেয়েছি। এখানেও রয়েছে ভাষার প্রসাদগুণ। শব্দগুলোকে বাক্যের কোন জায়গায় বসাবেন, কোন ধরণের শব্দ বসাবেন সেটি গদ্যেও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হৈমন্তি গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে। এখানে আপেক্ষিক গুরুত্ব একটি সাইন্টিফিক টার্ম, আর্কিমিডিস থেকে এসেছে। কিন্তু সেটাও বাক্যের সৃজন বৃদ্ধিতে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা গেল। সহজভাবেও নান্দনিক বাক্য গঠন করা যায়, কবিতার মতই। সুনিলের লেখা পড়েছেন সবাই। তাঁর বাক্যগুলো সরল হলেও হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মিষ্টি। কেমন যেন একটা আবেশ জড়ানো থাকে। অন্যদিকে শীর্ষেন্দু শব্দ নিয়ে বহুবছর রিসার্চ করেছেন, শব্দকে ভেঙ্গেছেন গড়েছেন। তাইতো তার লেখগুলো এত শক্তিশালী। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কথা না উল্লেখ করলে রীতিমতো অপরাধ হবে। রবীন্দ্রনাথ যেমন কঠিন এবং সহজ দুভাবেই বাক্যে মনন-সৃজন এনেছেন। মানিকও তাই। শেষতঃ উল্লেখ করব আমার মতে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় গদ্যকার, হয়ত সবচেয়ে বড় লেখক , অন্তত ভাষাকে বুননের দিক দিয়ে- সতীনাথ ভাদুরী। তার লেখার নান্দনিকতা স্পট অন। আমাদের দেশের অনেক শক্তিশালী লেখকরাও ভাষায় প্রসাদগুণ আনতে পারেন নাই, ইহাই প্রকৃত বাস্তব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ উপন্যাসে সাচিবিক বাংলা লিখেছেন, মনে হবে সরকারি প্রজ্ঞাপনের শব্দ পড়ছি। তবে উনি অনেক বড় লেখক, হয়ত এ বাংলার শ্রেষ্ঠ এই মর্মে যে, মানব মনের অতল গভীরের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, রুশ লেখকদের মত। শব্দের ব্যবহারে উনি সঠিক হলেও, সেই শব্দগুলো শতভাগ ব্যকরণ মেনে তৈরি করা হয়েছে, একুরেসি আনতে গিয়ে ঘাটতি হয়েছে প্রসাদগুণের । অন্যদিকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস করেছেন শব্দের অতিবিন্যাস, ওনার গদ্য হচ্ছে না গদ্য না পদ্য। বড় লেখক তবে এক ফোঁটার জায়গায় পাঁচ ফোটা ঢাললে যা হয়। বরং শব্দকে সঠিক এবং নান্দনিক রূপে ব্যবহার করেছেন আমাদের আহমেদ সফা, প্রবন্ধে এবং গদ্যে। সলিমুল্লাহ খান এমনিতেই তার ভুয়সি প্রশংসা করেন না। আমি এখন পর্যন্ত আহমেদ সফার একটা বাক্যেও ভুল ধরতে পারিনি। হুমাউন আহমেদ আনফরচুনেটলি ভাষায় কিছুই প্রসাদ আনতে পারেন নাই অথবা সে চেষ্টাও করেন নি। উনি গল্পকার, বঙ্কিম বা শরতের মত। আনিসুল যুগে এসে গদ্যের ভাষা হয়েছে অনেকটা আমি ভাত খাই টাইপের বাক্যের মত, অন্য লেখকরাও এখন গণহারে ভাষাকে প্রমিত করে চলছেন।
ভাষার প্রসাদগুণ বজায় থাকুক, কী পদ্যে, কী গদ্যে কী সামান্য ফেসবুক পোস্টেও। শহীদ দিবসে এটিই আমার চাওয়া।
ক্যালগেরি
২২ ফেব্রুয়ারি ,২০২৫ ইং
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন