শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০২৫

নতুন দল

পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন দল ইংল্যান্ডের দি টোরিজ, আর সবচেয়ে নবীন দল যেটা আজকে গঠিত হবে- জাতীয় নাগরিক পার্টি সংক্ষেপে এনসিপি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দলকে শুভকামনা।
অনেকদিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল, এখন ঠিক করেছে দল গঠন করবে। ৯০'এর গণ অভ্যুত্থানের ধরন ও প্রেক্ষিত আলাদা ছিল। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোই বিশেষত তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। তিন-জোটের-রূপরেখা নামে একটা চার্টার ছিল , স্বৈরাচার পতনের পরে কী কী করা হবে সেই বিষয়ে। সেই চার্টারে ভরসা রেখে আমরা জনগণ স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, সকল অশুভ শক্তি দেশ থেকে বুঝি পরাভূত হয়ে গেল। কিন্তু হায়। ৪৭ থেকে ৯০ কম পথ তো নয়, এরমধ্যে সামরিক-বেসমরিক মিলে কত নাটক মঞ্চায়িত হলো এই পোড়া দেশে। মানুষের মুক্তি আর হইল না।
দলও গঠন হয়েছে বিস্তর , প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। একেক দলের একেক রকম ভাবাদর্শ। ভাবাদর্শগুলো অবশ্য নামকাওয়াস্তে। যে দল ( যেমন জাসদ ইনু) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কায়েম করবে, সে কিনা একটা মন্ত্রীত্ব কিংবা এমপি পদের জন্য হাসিনার পা ধরে। বাসদ নামের দলটি- যারা বিপ্লবের পক্ষে কিন্তু ভোটের বিপক্ষে, তারাও দেখি হাসিনার জোটে শরীক হয়ে ভোট করে। মুখে সবাই সাম্য এবং মৈত্রির কথা বলে, বাস্তবে ব্যস্ত থাকে হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিতে। বাম-ডান মিলে অসংখ্য দল তৈরি হয়েছে, আবার বিলীন হয়ে গেছে। যে মুসলিমলীগ পাকিস্তান তৈরি করেছিল, তারা ৫৪'র নির্বাচনে ২৩৭ এর মধ্যে ৯ টো আসন পায়।
বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দল তৈরি হয়। কখনও মহান লক্ষ্য নিয়ে, কখনও খুচড়া কারণে। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার অব্যবহিত পরেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য প্রকট হওয়ায় সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, মুজিব মিলে আওয়ামীলীগ তৈরি করে। মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করাই সমীচীন মনে করেন তারা। এতে অবশ্য একটা লাভ হয়। রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটে। মুসলিম লীগ থাকলে আমাদের আর "সাধের লাউ" গান গাওয়া লাগত না। মনে নেই ১৯৬৭ সালে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করা হয়। আসলে পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতি আর পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি কোনমতেই এক নয়। পাকিস্তানিরা মিডল-ইস্টের আরও নিকটে, আরবদের মত তাদের নাক লম্বা, তারা পোলাওয়ে গোলাপজল দেয়, রাইতা দিয়ে কাবাব খায়, গজল শোনে ও সপ্তাহে একদিন গোসল করে। অন্যদিকে আমরা শীতের মধ্যেও প্রতিদিন পুকুরে ডুব দেই, ছোট মাছের চচ্চরি খাই, পান্তাভাত লাগেই, শীতে পিঠাপুলি,একতারায় বাউলের গান। কাজেই দেশ স্বাধীন হবেই এবং হয়েছেও। ষাটের দশক উত্তাল রেখেছে আওয়ামীলীগ, মেজর বামপন্থী দল, আওয়ামীলীগ থেকে সড়ে আসা ন্যাপ মিলে। সেই সময়ে কিউবা, ভিয়েতনাম, চীন এবং সর্বপরি নকশাল আন্দোলনের প্রভাবে প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তির ভালই উদ্ভব ঘটে।
স্বাধীনতার পরে বিশাল ধাক্কা খায় দেশ। আমলাদের অসহযোগিতা, আওয়ামীলীগের দেশ চালাতে অদক্ষতা, অনেকের অস্ত্র জমা না দেয়া, লুটপাট, কারখানার যন্ত্রাংশ বিক্রি, ব্যাংকের ভল্ট খালি করা ইত্যকার নানা সমস্যায় জর্জরিত হয় দেশ। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান-ফেরতদের বৈরিতা শুরু হয়। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী শসস্ত্র অভ্যুত্থানের বাসনা এবং প্রস্তুতি চলে। লীগের একটা অংশ ছিটকে গিয়ে জাসদ গঠন এবং আওয়ামীলীগকে দৌঁড়ের উপর রাখে। অন্যদিকে সিরাজ শিকদার শ্রেণিশত্রু খতম করতে শুরু করে। সাতকোটি লোকের জন্য আটকোটি কম্বল আসলেও সব কম্বল পরিশেষে চুরি হয়ে যায়, সবমিলিয়ে হজপজ একটা অবস্থা। ফলশ্রুতিতে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ নামে। এই অবস্থায় কে বা কারা বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল গঠন করার পরামর্শ দেয় অথবা তার নিজের মাথায় আসে আইডিয়াটা - ইতিহাসের চরম একটা ভুল। বাকশাল এমনিতেই থাকত না কারণ বিষয়টা ন্যাচারাল নয়। মাঝখানে পুরো পরিবার শেষ।
তারপর বিএনপির জন্ম। আমি অবশ্য ছোটদলগুলোর জন্মের কথাও বলতে চাই, কিন্তু পোস্ট বড় হবে বিধায় সম্ভব নয় যেমন দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দল, মনে আছে দিলীপ বড়ুয়াকে ? ঐ যে বক্তব্য দিতে গিয়ে পায়জামা খুলে পড়ে গিয়েছিল। কিংবা কল্যান পার্টির কথা মনে আছে? মোছওয়ালা ঈব্রাহিম সাহেব, বিট্রে করে ২৪ এর নির্বাচনে গিয়েছিল। কিংবা অলি আহমেদের এলডিপি, অথবা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা, ডঃ কামালের গণফোরাম, এমনকি যে দরবেশবাবা জেলে, সেও একটা দল করেছিল স্ব-নির্ভর বাংলাদেশ বলে, মাছমার্কা প্রতীকে নির্বাচনও করেছিল।
যাইহোক বিএনপির কথা বলছিলাম। যেখানে বড় দল ভেঙ্গে টুকরা হয়ে ছোট দলের সৃষ্টি হয়, সেখানে নানা মতের নানা পথের মানুষ ধরে নিয়ে এসে একটি দল গঠন করা দুরূহ বিষয় হলেও জিয়া সেটি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে করতে পেরেছিলেন। সাথে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন। মোটকথা বাকশাল বাতিল হয়ে আগের অবস্থা জারি হয়েছে আবার। সাধারণ মানুষ জিয়ার সাথে ছিল। ক্যাপ মাথায় দিয়ে, একটা রে-বেন সানগ্লাস পরে ছাদখোলা জিপ গাড়িতে চড়ে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তাকেও মেরে ফেলা হয়। সারা দেশের মানুষ কেঁদেছিল সেদিন। আমি ছোট ক্লাশে ছিলাম, খবর শুনেই স্কুল ছুটি দেয়, স্কুল থেকে হেঁটে যখন বাড়ি আসছিলাম, চারপাশে দেখছিলাম সবকিছুই স্তব্ধ।
এরপরে আসে জাতীয় পার্টি। এরশাদ অনেক দোষে দোষী হলেও, নয়বছর কিন্তু গদিতে টিকে ছিল। ভারতের আশীর্বাদপুষ্টে নাকি স্বীয়-যোগ্যতায় তা অবশ্য বলতে পারব না, তবে নয় বছরে ভারতকে চটিয়ে কিছুই করেনি। অবকাঠামো বিশেষ করে রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়,উপজেলা তৈরি হয়। দোষে-গুণের এরশাদের দোষের পাল্লাই ভারী ছিল। নারীদোষ, কবিতাচুরি, এবং কথা-না-রাখার বিষয়ে বিখ্যাত ছিল। কীভাবে ভোট-ডাকাতি করত নিজের চোখেই দেখেছি। দিনে দিনে স্বৈরাচার হয়ে ওঠে সে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দেয়। অবশেষে পতন এবং জেল। পালাতে পারেনি কিংবা চায়নি বিষয়টা ঠিক জানা নেই। তবে রংপুরের মানুষের সিমপ্যাথি ছিল তার প্রতি অযথাই। জেলে থেকে ভোট করেও ৩৫ আসন পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। একটা ভাল দল হতে পারত,
দলটাকে নষ্ট করেছে তার ভাই কাদের এবং স্ত্রী রওশন। গত পনের বছরে জাতীয় পার্টি যদি বিন্দুমাত্র কোমড় সোজা করে থাকতে পারত, হাসিনার পক্ষে এতবড় ফ্যাসিস্ট হওয়া সম্ভব ছিল না।
এখন মাঠ ফাঁকা । বিএনপির বিরুদ্ধে একটা মানসম্পন্ন বিরোধীদল খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। অনেকে জামাতের কথা বলছে। ৯৬ সনের কথা ভাবুন, জামাত একা নির্বাচন করে ৩ টি আসন পেয়েছিল। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামাতের সিট বাড়বে কিনা জানিনা, বাড়লে আর কত বাড়বে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দল আগামী নির্বাচনে কেমন রেজাল্ট করবে জানি না। কর্মী সংগ্রহ আছে, দল গোছানো আছে, তা ছাড়া আওয়ামীলীগ যদি নির্বাচন করতে না পারে, তাহলে আওয়ামীলীগের সমর্থক আর যাকে ভোট দিক মরে গেলেও ছাত্রদের দলকে ভোট দিবে না। ছাত্রদের উপর দুনিয়ার রাগ জমা হয়ে আছে তাদের অন্তরে। নতুন দলের ভোট আসবে নন-আওয়ামীলীগদের থেকেই। তবে প্রথম নির্বাচনটা তো বড় কথা নয়। যারা হাসিনার মত দানবকে ৩৬ দিনে টেনে নামিয়েছে তাদের মধ্যে পটেনশিয়াল আছে। একতা বজায় রাখলে আগামীতে তারা ভাল করবেই। তাদের দল গঠনের প্রেক্ষিত অন্য অনেক দলের চেয়ে অনেকাংশে জোড়াল। ছোটখাটো ভুল হবে, বড়সড় ভুল হবে, অনেকেই পথচ্যুত হবে, অনেকেই পথে ফিরে আসবে, এভাবেই দিনে দিনে মহিরুহু বৃক্ষে পরিণত হবে।
ক্যালগেরি


Like
Comment
Send
Share

সোমবার, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০২৫

আমার জন্মদিন ও থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র


ভাবছেন, এ দুটোর মধ্যে আবার সম্পর্ক কী? একটু পরেই ব্যাখ্যা করছি। প্রথমত আজ আমার জন্মদিন, মনে ছিল না। যেহেতু ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম ফ্রেমওয়ার্কের অধীন, আমার তথাকথিত অফিস থেকে সতীর্থদের ডিজিটাল উইশ আশা শুরু করল অবিরাম গতিতে। কাহাতক আর ভুলে থাকা যায় ? এনিওয়ে, হ্যাপি বার্থ-ডে টু মি।
জন্মদিন নিয়ে আমার ব্যতিব্যস্ত হওয়া কী মানায়? তিনকুল তো পার হয়ে গেল। মেয়েরা স্কুল থেকে এসে চুপ করে হাতেলেখা কার্ড বানাবে, এটা বলে দেয়া যায়, এটুকু ফর-গ্রান্টেড, প্রকৃতি বাপদের-প্রতি-মেয়েদের ভালবাসা এভাবেই ডিজাইন করে রেখেছে। কেক-টেক কাটা হবে কিনা এখনো বলতে পারছি না। যদি কেক আনা হয়, কাটব, অসুবিধা কী?
হ্যাঁ ফিজিক্সের কঠিন সূত্রটির বিষয়ে আসি। সত্য ঘটনা। আমি তখন ফোরে পড়ি। আব্বার সাথে বাজারে যাই। অনেকদূর হেঁটে গোশালা বাজারে যেতে হয়। একজায়গায় ইটের ভাটা ছিল, রাস্তার বামপাশে। অন্যপাশে আবুল এমপির বাঁশের ঝার এবং একটি কাকচক্ষু জলের দীঘি। সেই জায়গাটায় এসে আব্বাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আব্বা আমার জন্মদিন কবে? আব্বা সঠিক জবাব দিতে পারে নাই, কারণ যেই ডায়েরিতে তারিখটা লেখা ছিল তা কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে ? আব্বা বলেছিল, তাতে কী? আসলে জন্মদিন বিষয়ে কোন ব্যাপার থাকার কথা নয়। কারণ আমরা যে বছর হিসাব করি তা পুরোপুরি আপেক্ষিক একটি বিষয়। আমাদের গ্রহ ৩৬৫ দিনে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। প্রতিটি জন্মের ৩৬৫ দিন পরে যা ঘটবে তা হচ্ছে একই রকম আবহাওয়া পাওয়া যাবে, কারণ পৃথিবী সূর্য থেকে একই রকম দূরত্বে অবস্থান করবে। সময় হচ্ছে পরিপূর্ণ আলাদা একটা জিনিস। এটা ফিরে আসে না, কোনদিনও নয়। আব্বা যেটা বলতে চেয়েছিল, সময় পরম, এর যাত্রা কোন একসময় শুরু হয়েছিল, কোন একসময় হয়ত শেষ হবে।
এখানে বলে রাখি, আব্বা ছিল আর্টসের ছাত্র। অথচ সময় নিয়ে তার ব্যাখ্যা প্রায় পুরোপুরি ঠিক। সময় এবং স্থান সৃষ্টি হয়েছিল ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং থেকে। তার আগে কিছু ছিল না। সময় একটি নদীর মত, একদিকে প্রবাহিত হয়। সময়কে খুব সহজ বিষয় মনে হলেও একে সংজ্ঞায়িত করা ছিল খুব কঠিন। ইংল্যান্ডে যখন বাষ্প-ইঞ্জিন আবিষ্কার হয় তখন একটা সমস্যা দেখা দিল। সেটা হচ্ছে প্রচুর কয়লা চুলায় ঢালতে হচ্ছে টারবাইন ঘুরানোর জন্য। আমরা ছোটবেলায় এটি দেখেছি লালমনিরহাটে। তখন কয়লার ইঞ্জিন ছিল, ইঞ্জিন রুমে দুজন খালাসি লুঙ্গি মালকোচা করে সর্বদা বেলচি দিয়ে চুলায় কয়লা ঢালত। তবেই স্টিম তৈরি হত এবং ট্রেন চলত। এই বাষ্পীয় ইঞ্জিন ছিল খুবই আনএফিসিয়েন্ট। যে হারে কয়লা ঢালা হত চুলায়, বাষ্পও উৎপাদিত হত ভালই, কিন্তু কোন এক চোরাকারণে পুরো বাষ্পকে কাজে লাগানো যেত না। বেশিরভাগ বাষ্প লিক হয়ে যেত। এই বিষয় নিয়ে সেই সময়কার বিজ্ঞানীরা মাথা চুলকিয়েছে অনেক, কেন এমন হচ্ছে? এবং পরিশেষে তা ব্যাখ্যা করা গিয়েছে থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র দিয়ে। সেই সূত্র কিন্তু খুব কঠিন। আমি বুয়েটে দুটো সাবজেক্ট পড়েছি থার্মোডাইনামিক্সে উপর, তবুও এখনো বিষয়টাকে ঝাপসা লাগে। কাজেই সেটার ব্যাখ্যা শুনলে সম্মানিত পাঠকরা পালাবে। তবুও সহজতর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছি।
থার্মোডানামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র থেকে একটি বিষয় এসেছে যার নাম এনট্রপি। এটি এমন এক জিনিস যার মান শুধু বাড়তেই থাকে। মানে এখনো বাড়ছে। সৃষ্টির শুরুতে হয়ত জিরো দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তারপর প্রতিদিন বাড়ছে , এমনকি প্রতি মূহুর্তেই বেড়ে চলেছে। এনট্রপি তখনই বাড়বে যখন অর্ডার (শৃঙ্খল) থেকে ডিসঅর্ডার (বিশৃঙ্খল) অবস্থায় পৃথিবী যাবে (আসলে পুরো বিশ্ব যাবে)। তারমানে হচ্ছে আমরা প্রতিটি দিনে, প্রতিটি মুহুর্তে শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সৃষ্টির শুরুতে পুরো বিশ্ব সবচেয়ে সুশৃংখল ছিল। তারপর প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খল হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। আপনার হাতে একটি কাঁচের গ্লাস আছে। অসতর্কতা বশত সেটি মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে খানখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এটি হচ্ছে শৃঙ্খল থেকে বিশৃঙ্খল হওয়ার পকৃষ্ট উদাহরণ, অর্থ্যাৎ ছোট পরিসরে এনট্রপি বাড়ল। কোন অবস্থাতেই কিন্তু কাঁচের টুকরোগুলো উল্টোদিকে গিয়ে জোড়া লাগবে না, যদি লাগত তাহলে সময় উল্টোদিকে যাত্রা করতে পারত, এনট্রপি বাড়ার পরিবর্তে কমতেও পারত। কিন্তু সেটি হয়না। কাজেই সময়ের সঠিক সংজ্ঞা এখন আমরা দিতেই পারি। সময় হচ্ছে প্রতিনিয়ত এনট্রপি বাড়া, সেকেন্ড-ল-অফ-থার্মোডাইনামিক্স। এই বিশ্ব প্রতিনিয়ত শৃঙ্খল থেকে বিশৃঙ্খল হবে, সেটাই সময়। একটি সুন্দর শহর একসময় ধ্বংস হবে, আমাদের এই পৃথিবীও একসময় ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, কারণ সূযের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে (হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি বন্ধ হলে) আইনস্টাইনে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সূর্যকে টেক-ওভার করবে। সাদা বামনে পরিণত হওয়ার আগে সূর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে আমাদের পৃথিবীসহ সবগ্রহকে খেয়ে ফেলবে। আমরা থাকব সূর্যের পেটের ভিতর। তারপর একসময় সাদা বামন হবে সূর্য। তারপর একসময় কালো বামন, তারপর ব্লাক হোল। সব নক্ষত্রের পরিণতি তাই-ই। ব্লাকহোলগুলো একসময় শক্তি বিকিরণ করতে করতে শেষ হয়ে যাবে। তারপর এই বিশ্বের কোথাও এক কণা শক্তিও অবশিষ্ট থাকবে না। বিশ্ব হবে নিথর বিরানভূমি, হুমাউন আহমদের নাটক কোথাও-কেউ-নেইয়ের মত, ফিজিক্সের ভাষায় একে বলে হিট-ডেথ। সব শেষ। এনট্রপি আর বাড়বে না। থমকে যাবে সময়।
কাজে কাজেই, বার্থডে ফিরে আসে না বৎস, সময়ের তীর একদিকেই ছোটে। যে মাহেন্দ্রক্ষণে আমি জন্মেছিলাম, সেই ক্ষণ আর আসবে না। বরং বলতে পারি আমি ২৫ ফেব্রুয়ারি তিস্তার বসুনিয়া বাড়িতে জন্মেছিলাম, সেইদিনটা ছিল শীত শীত। আজকেও একই রকম আবহাওয়া। এতটুকুই।
ক্যালগেরি
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ইং

শনিবার, ফেব্রুয়ারী ২২, ২০২৫

ভাষার প্রসাদগুণ

 মাদের ভাষা আমাদের মাটির মতই প্রাচীন। তবে পৃথিবী যেমন বিবর্তিত হয়, সমাজ যেমন বিবর্তিত হয়, তেমনি ভাষাও। বিজ্ঞজনের মতে পাল আমল থেকে প্রাচীন বাংলার উৎপত্তি। তার আগে যা ছিল তা আর্যদের নিজস্ব, তাতে হয়ত দ্রাবিড়, কোলের মত অনার্য ভাষার উপাদান কিঞ্চিৎ মিশেল থাকতে পারে, তবে তা বাংলা নয় । পাল বংশ শুধু আদি বাংলার বিকাশ ঘটায়নি, এ যুগে শুরু হয়েছে সাহিত্য রচনা, তবে তা পদাবলীর আদলে। আর আমাদের ভাষার প্রসাদগুণ এখান থেকেই শুরু। সেটা নিয়েই এই পোস্ট।

আমরা অনেক সময় বলি, ছেলেটি/মেয়েটি/লোকটি সুন্দর করে কথা বলে। বা অমুখ লেখক সুন্দর লেখে। অর্থ্যাৎ তারা শব্দগুলোকে কাব্যিকভাবে বিন্যাস করে, যা শ্রতিমধুর ব্যঞ্জন সৃষ্টি করে, শুনে কানের আরাম হয়, চিত্ত উদ্বেলিত হয়। একটি বাক্য ধরা যাক, বাইরে খুব বাতাস উঠছে, একে আর কীভাবে বলা যায়? তীব্র বাতাস বইছে চারিধারে? অথবা বাতাস উঠেছে হাটুভাঙ্গা সিংহের মতন। তেমনি, কিছু মানুষ বাগান থেকে গোলাপ তুলছে, কবিরা বলবে- বাগানে গোলাপ তোলার উৎসব। কেউ অভিমান করেছে- কবিরা বলবে বুক জুড়ে আছে অভিমানের বাষ্প।
বলছিলাম প্রাচীন বাংলার পদাবলীর কথা। চর্যাপদের কথাই ধরা যাক। একটি পদ আছে এমন- দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামায়? মানে হচ্ছে গরুর বাট থেকে বের হওয়া দুধ কি আবার ফিরিয়ে নেয়া যাবে? আমরা যেমন বলি, টুথপেস্ট টিউব থেকে বের হলে তা আর ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, অথবা যে গুলি ছোড়া হয়েছে তা ফেরত নেয়ার উপায় নেই। গরুর বাট বিষয়টিতে নান্দনিকতা হয়ত নেই, তবে এটা চর্যাপদের একটি পদ বিধায় এর গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না। আগেকার আমলের কবিরা উপমা দিতে এরকম প্রাণীকুলের উল্লেখ করতেন। মধ্যযুগের কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর মাতৃস্নেহের উপমা দিতে গিয়ে বলেছেন - পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত। পিঁপড়া কামর দিবে বলে মা তার সন্তানকে মাটিতে শুইতে দেয় নাই- এরূপ মাতৃস্নেহ।
এরপর যখন আধুনিক যুগ শুরু হলো। কবিদের লেখায় ধীরে কিন্তু নিশ্চিন্তে নান্দনিকতার সৃজন হলো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কী পাও ? তারই রথ নিত্যই উধাও। বাংলায় তৎসম তদ্ভব মিলিয়ে বিশাল শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এগুলোই পারমুটিশন কম্বিনেশন করে সৃজনশীল রূপ দিতে হবে কবিতায়, গল্পে। লেখক এখানে স্বাধীন। কোন নিয়ম নেই। গানে যেমন সি-কর্ডের পরে এ-মাইনর কর্ড না দিলে অন্যায় হবে। কবিতায়, গল্পে, গদ্যে সেই নিয়মের বালাই নেই। রবি ঠাকুরের গুরুগম্ভীর কবিতার চরণ বাদ দিলেও - অতি সাধারণ যে প্রাকৃতজনের বাংলা, সেখানেও শব্দের সুচারুবিন্যাস ঘটিয়ে অতি নান্দনিক পদ সৃষ্টি করা যায়, করেছেনও তাই। রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে লিখেছেন- রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ মিথ্যে নয়। একটাও ভারি শব্দ নেই, কিন্তু শুনতে কী দারুণ - আর তার গুঢ় ভাবার্থের কথা কী বলব?
শব্দ নিয়ে খেলায় সবার চেয়ে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে আছেন আমদের জীবনানন্দ দাশ। কী কথা তাহার সাথে তার সাথে ? একটি সর্বনাম পদের সাধু ও চলিত রূপ ব্যবহার করে কী অসাধারণ একটি বাক্য গঠন করলেন। আরেকটি পদের কথা ধরুন। সেখানে মৃত্যুকে ঘুমের সাথে তুলনা করেছেন কবি - এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি! রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি। উকিল মুন্সীও অবশ্য মৃত্যুকে ঘুমের সাথে তুলনা করে লিখেছেন - সোয়া চাঁন পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি? উকিল মুন্সির মত সুফিবাদী কবিয়ালরাও সেই মধ্যযুগ থেকেই শব্দ নিয়ে খেলছেন। শব্দকে বিন্যাস করছেন সহজীয়া উপায়ে।
গদ্য এসেছে অনেক পরে। ১৮শ শতকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথমবারের মতো গদ্য-ভাষার কার্যকর ব্যবহার শুরু হয়। সাধু ও চলিতের দোলাচলে অনেকদিন চলে শেষ পর্যন্ত চলিত কালের যাত্রায় টিকে আছে। আমরা আধুনিক গদ্য পেয়েছি। এখানেও রয়েছে ভাষার প্রসাদগুণ। শব্দগুলোকে বাক্যের কোন জায়গায় বসাবেন, কোন ধরণের শব্দ বসাবেন সেটি গদ্যেও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হৈমন্তি গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে। এখানে আপেক্ষিক গুরুত্ব একটি সাইন্টিফিক টার্ম, আর্কিমিডিস থেকে এসেছে। কিন্তু সেটাও বাক্যের সৃজন বৃদ্ধিতে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা গেল। সহজভাবেও নান্দনিক বাক্য গঠন করা যায়, কবিতার মতই। সুনিলের লেখা পড়েছেন সবাই। তাঁর বাক্যগুলো সরল হলেও হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মিষ্টি। কেমন যেন একটা আবেশ জড়ানো থাকে। অন্যদিকে শীর্ষেন্দু শব্দ নিয়ে বহুবছর রিসার্চ করেছেন, শব্দকে ভেঙ্গেছেন গড়েছেন। তাইতো তার লেখগুলো এত শক্তিশালী। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কথা না উল্লেখ করলে রীতিমতো অপরাধ হবে। রবীন্দ্রনাথ যেমন কঠিন এবং সহজ দুভাবেই বাক্যে মনন-সৃজন এনেছেন। মানিকও তাই। শেষতঃ উল্লেখ করব আমার মতে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় গদ্যকার, হয়ত সবচেয়ে বড় লেখক , অন্তত ভাষাকে বুননের দিক দিয়ে- সতীনাথ ভাদুরী। তার লেখার নান্দনিকতা স্পট অন। আমাদের দেশের অনেক শক্তিশালী লেখকরাও ভাষায় প্রসাদগুণ আনতে পারেন নাই, ইহাই প্রকৃত বাস্তব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ উপন্যাসে সাচিবিক বাংলা লিখেছেন, মনে হবে সরকারি প্রজ্ঞাপনের শব্দ পড়ছি। তবে উনি অনেক বড় লেখক, হয়ত এ বাংলার শ্রেষ্ঠ এই মর্মে যে, মানব মনের অতল গভীরের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, রুশ লেখকদের মত। শব্দের ব্যবহারে উনি সঠিক হলেও, সেই শব্দগুলো শতভাগ ব্যকরণ মেনে তৈরি করা হয়েছে, একুরেসি আনতে গিয়ে ঘাটতি হয়েছে প্রসাদগুণের । অন্যদিকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস করেছেন শব্দের অতিবিন্যাস, ওনার গদ্য হচ্ছে না গদ্য না পদ্য। বড় লেখক তবে এক ফোঁটার জায়গায় পাঁচ ফোটা ঢাললে যা হয়। বরং শব্দকে সঠিক এবং নান্দনিক রূপে ব্যবহার করেছেন আমাদের আহমেদ সফা, প্রবন্ধে এবং গদ্যে। সলিমুল্লাহ খান এমনিতেই তার ভুয়সি প্রশংসা করেন না। আমি এখন পর্যন্ত আহমেদ সফার একটা বাক্যেও ভুল ধরতে পারিনি। হুমাউন আহমেদ আনফরচুনেটলি ভাষায় কিছুই প্রসাদ আনতে পারেন নাই অথবা সে চেষ্টাও করেন নি। উনি গল্পকার, বঙ্কিম বা শরতের মত। আনিসুল যুগে এসে গদ্যের ভাষা হয়েছে অনেকটা আমি ভাত খাই টাইপের বাক্যের মত, অন্য লেখকরাও এখন গণহারে ভাষাকে প্রমিত করে চলছেন।
ভাষার প্রসাদগুণ বজায় থাকুক, কী পদ্যে, কী গদ্যে কী সামান্য ফেসবুক পোস্টেও। শহীদ দিবসে এটিই আমার চাওয়া।
ক্যালগেরি
২২ ফেব্রুয়ারি ,২০২৫ ইং

শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ০৭, ২০২৫

বই ও মাঠের গল্প

 কুশের বইমেলা সম্বন্ধে সবসময়ই আমার একটু দুর্বলতা ছিল। সেটা যে পুরোটা বইয়ের জন্য তা নয়, দোকানগুলো সৃজনশীল, দোকানিরা পরিচ্ছন্ন, ক্রেতারাও রুচিশীল। মেলার বাইরে পোড়া ভুট্টা, চটপটি (যদিও কোনসময়ই আমার পছন্দ নয়), কতকিছুর বিপণী। হুমাউন আহমেদ বিকাল থেকে বসতেন অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে। অটোগ্রাফ নেবার লম্বা লাইন পড়ত সামনে। হুমাউন আজাদ পুরোটা সময় বসে থাকতেন একটা স্টলে, নাম ভুলে গেছি, হাতে সিগারেট থাকত সব সময়। কোন এক সময় মেলার কোনদিকে হট্টগোল শোনা গেলে বোঝা যেত তসলিমা নাসরিনের উপর আত্রমণ হয়েছে কোথাও।

আমি নব্বই দশকের কথা বলছি। মেলার খুব কাছেই থাকতাম, বুয়েটের আহসানুল্লাহ হলে, মেলা যেতে রিক্সাভাড়া লাগত পাঁচ টাকা, চাইলে হেটেও যাওয়া যেত।
মেলার একটা জিনিস আমার ভাল লাগত, বিভিন্ন স্টলে বিশ্ববিদ্যলয়/কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা একমাসের জন্য চাকরি পেত। পার্ট-টাইম চাকরি। আমাদের দেশে হতভাগা ছাত্র-ছাত্রীদের পার্ট-টাইম জব বলতে শুধুই টিউশনি বোঝায়। অথচ যেকোনো অফিস-আদালতে তাদের পার্ট-টাইম চাকরি হওয়ার কথা। বিদেশে তো তাই হয়। অফিসগুলো ছোট বাচ্চাদেরকেও কাজ করতে দেয়, বিশেষ করে সামারে। তা ছাড়া রেস্টুরেন্টেও কাজ করা যায়। আমাদের দেশে সেই কালচার আর হল না। কোন ছাত্র রেস্তোরাঁয় ক্যাশে বসলে সমাজ তাকে নিয়ে টিটকেরি করবে। এই বিষয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ল। দিন তারিখ মনে নেই যদিও। প্রেসক্লাবের সামনে একটি রেস্টুরেন্ট, ভাত খেতেই মানুষ আসে বেশি। কোন এক দিন সেখানে গিয়ে দেখি, ক্যাশে বসে আছে আমারই এক স্কুল ফ্রেন্ড, নাম বলছি না যদি সে বিব্রত হয়। আমার সাথে সে সহজাত আচরণ করল। ছেলেটি ঢাকায় এসে স্ট্রাগল করছে। টিউশনি করাত কিনা জানি না, এই হোটেলে চাকরি করছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি, পড়াশুনা এবং থাকাখাওয়ার যোগান দেয়ার জন্য। এটুকু বলতে পারি, বুয়েট থেকে বেড়িয়ে যখন চাকরি নিলাম, আমরা যে বেতন পেতাম তা বাজারে খারাপ ছিল না, তবে আমার সেই বন্ধুটি সেইসময় আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বেতনে চাকরি করত। এইটাই মাঠের গল্প, বই থেকে পাওয়া নয়।
বই ও মাঠের গল্পে অনেক ফারাক থাকে। মাঠের ঘটনাগুলোকে বইয়ে স্থান দেয়া যায় না, দেয়া হয় না। অথবা দেয়ার ক্ষমতা লেখকদের নেই। আমাদের লেখকরা মধ্যবিত্তদের নিয়েই শুধু লিখতে পারে। উচ্চবিত্তেরের বৃত্তে তারা ঢুকতে পারে না, আবার নিম্নমধ্যবিত্তকে নিজেরাই ছোটলোক মনে করে। তাইতো মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত লেখা আমরা পাইনা। আমাদের লেখক/শিক্ষক/প্রবন্ধকার সবই চাটুকার বনে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আটহাজার বই লিখা হয়, অথচ তার বাড়ি ভাঙ্গার সময় একজনকেও প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না মাঠে। ওই যে বললাম, মাঠ আর বইয়ের রাজ্যের পার্থক্যের কথা। মাঠে গল্প তৈরি হয়, সেই গল্প মিস করে ফেলে আমাদের লেখকরা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত গল্প লেখা হয়েছে? হাজার হাজার তো হবেই, এইসব লেখকের অধিকাংশ দেশে ছিল না সেইসময়, ছিল কোলকাতায়, যুদ্ধের পর ফিরে এসে আরাম কেদারায় বসে, গরম কফির মগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা গল্প লিখেছে।
অথচ মাঠেই চরিত্র ঘোরাফেরা করে, আসল চরিত্র, যে লেখে সেও হয়তবা মাঠের একটা চরিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাশিয়ার যত যুগান্তকারী উপন্যাস লেখা হয়েছে তা লিখেছে যুদ্ধ করা সৈনিকরা। কিছুদিন আগে বদরুদ্দীন ওমরের লেখা 'আমার জীবন' বই পড়ছিলাম। কয়েকটি খণ্ডে। এক জায়গায় লেখা আছে, উনি যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, গ্রামে যেতেন মাঝেমধ্যে, থাকতেন কৃষকদের বাড়িতে। একবার কোনো এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতে, কিশোরগঞ্জের কোথাও। তার সাথে একজন সহযাত্রী ছিল, আপনারা চিনবেন, মুরগি কবির। শাহরিয়ার কবির যে বালিশটা নিয়েছিলেন সেটায় ছিল কৃষকের ঘামের বোটকা গন্ধ। তার ঘুম আসছিল না। ধান্দায় ছিল বদরুদ্দিন ওমর সাহেবের বালিশটা যদি হাতিয়ে নিতে পারেন। একসময় প্রকৃতির ছোট চাপে বদরুদ্দিন ওমরা সাহেব বাইরে গেলেন। এই সুযোগে শাহরিয়ার কবির দ্রুত বালিশটি বদলিয়ে ফেললেন। ওমর সাহেব সেটা টের পেয়েছিলেন, কিন্তু ভদ্রতা করে বলেন নি, তবে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন এই কবিরকে দিয়ে জাতির কিছুই হবে না।
উপরের গল্পটি বললাম কবিরকে ছোট করার জন্য নয়। বললাম আগেকার লেখকরা গ্রামে যেত, বদরুদ্দিন ওমরের বইয়ে এরকম আরও ঘটনা লেখা আছে। আমাদের আরেকজন লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, খোয়াবনামা লেখার সময় গ্রামে গিয়ে থেকেছেন। মানিক বন্দোপাধ্যায় পদ্মা নদীর মাঝি লেখার সময় জেলে বস্তিতে গিয়ে ছিলেন।
মাঠের গল্প লিখতে গেলে মাঠে যেতে হবে, অথবা হতে হবে মাঠের সন্তান। আমাদের মাঠের সন্তান তো কৃষক, তারা তো পড়তেই জানে না, সই বলতে টিপসই। জিয়ার আমলে এইসব মূর্খ লোকদের আলোকিত করার জন্য নৈশ ইস্কুল ছিল। আমাদের বাড়ির পাশেই রাতে এক হিন্দুবাড়ির উঠোনে স্কুল বসত। তারপর কবেই সেইসব চুকেবুকে গেছে। অশিক্ষিতরা আরো অশিক্ষিত হচ্ছে। কারা লিখবে বই?
যারা প্রবন্ধ লেখে তারা চেতনায় বলীয়ান হয়েই লেখে, চেতনাই তাদের একমাত্র সম্বল। যারা উপন্যাস লেখে, সেই আমি-তুমি-সে। হুমাউন আহমদে আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ছোট কিশোরীরা কীভাবে বুড়োদের প্রেমে পড়বে। যে 'দেয়াল' নিয়ে আপনারা এত মাতামাতি করেন, সেই দেয়ালের দুটো মেইন চরিত্র অবন্তি- সেখানে পুরো শাওনের ছায়া দেখবেন, দাদা চরিত্র সরফরাজ খানের মধ্যে পুরো চ্যালেঞ্জারকে খুঁজে পাবেন। শেষ জীবনে হুমায়ূন যত লিখেছেন সবকিছুতেই শাওন ঘুরপাক খেয়েছে। লেখক হিসাবে এভাবেই তার অধঃপতন ঘটেছে। ভাল লেখক বলতে এখন নেই, হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও বইমেলা চলবে, লোকে একুশে পদক পাবে। দেখা যাক একদিন যদি ভাল সময় আসে।
ক্যালগেরি
ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫ ইং

সোমবার, ফেব্রুয়ারী ০৩, ২০২৫

ট্রাম্পের ট্যারিফ

 নাফটা চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডা, মেক্সিকোর সাথে ট্রেড-ওয়ার শুরু করল। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে জমে ওঠা মুক্ত বাজার অর্থনীতির, যার জন্য প্রায় সব দেশেই প্রভুত উন্নতি সাধন হয়, অপমৃত্যু হল ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে।

১৭৭৬ সালে এডাম স্মিথ মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা প্রস্তাব করেন। তার মতে, দক্ষ এবং সাশ্রয়ী শ্রমিকরা তৈরি করবে পণ্য, তা তারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন। সেই পণ্য জটিল এক সাপ্লাই-চেইনের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছবে। উপকৃত হবে প্রতিটি দেশ। মার্কেট ইকনোমির অর্থ হচ্ছে পণ্যের সাপ্লাই-ডিমান্ডে সরকারের নাক না গলানো এবং পণ্য যাতে ফ্রি-ফ্লো হয় তাতে সহায়তা করা। এর প্রথম শর্ত অযথা ট্যারিফ তুলে দেয়া।
বলশেভিক বিপ্লবের পরে কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর বড় একটি অংশ মার্কসিও অর্থনীতির বাস্তব-প্রকাশ প্লানড ইকোনোমিক্স চর্চা করে, যেখানে রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে দেশে কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদিত হবে, সেটিও টেকশই হয়নি, বাহ্যত কমিউনিস্ট দেশগুলো মিশ্র ধনতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে, কোনটি আবার অকাট্য শ্বৈরতান্ত্রিক দেশে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গেছে, দুই জার্মানি জোড়া লেগেছে। ভবিষ্যতে দুই-কোরিয়া যুক্ত হলেও আশ্চর্য হব না।
একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ফেরত এক ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাই, রাশিয়া দেশটি সম্পর্কে আমার অনেক কৌতুহল, বিশেষ করে তাদের রাস্তায় কোন ধরণের গাড়ি চলে, বাসায় কোন কোম্পানির ফ্রিজ, সেগুলো কি সোভিয়েতে তৈরি নাকি অন্য কোন দেশের? উত্তরে সেই ভাই বলেছিল, ওখানকার ফ্রিজগুলোর ওজন অনেক বেশি, জীবনেও নষ্ট হয়না, টেকে শতবছর। সেই উত্তর শুনে আমার মনে হয়েছিল, তাহলে ফ্রিজ কোম্পানিগুলো তো নতুন ফ্রিজ বানাতে পারবে না, কারণ কারও বাসার ফ্রিজ সহজে নষ্ট হচ্ছে না, তার মানে কোম্পানিগুলো উঠে যাবে, যার অর্থ হচ্ছে লোকে চাকরি হারাবে। বিষয়টি তুচ্ছ হলেও এর একটা গুঢ় অর্থ আছে। সমাজে টাকার প্রবাহ বহমান থাকা জরুরি, যেই দেশে মানুষ তার ইনকামের বড় একটা অংশ ব্যয় করবে পণ্য কেনায়, সেখানে ইন্ড্রাস্টি বিকশিত হবে লোকে চাকরি পাবে, এবং সর্বপরি মানুষ ভাল থাকবে। ভারতবর্ষে লোকে আগে সিন্দুকে টাকা জমাতো, ব্যংক ছিল না। ব্যাংক থাকলে যেটি সুবিধা, অন্য লোক আপনার জমাকৃত টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে এবং লোকে সেখানে চাকরি পাবে। অবশ্য কোনো দেশে সুফি দরবেশ বাবার মত দুষ্ট শক্তির আবির্ভাব হলে এবং ব্যাংকগুলো লুটে নিলে আম-ছালা দুটোই যাবে।
এবার বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আসি। না, ওনার সমালোচনা করছি না। ওনার লেখা বইগুলো আমি যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি। প্রত্যেকটা বই দারুণ উপভোগ্য। তো 'আমার দেখা নয়াচিন' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- চিনে গিয়ে সেভ করার জন্য যে ব্লেডগুলো দেশ থেকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন তা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। উনি বাজারে গেলেন ব্লেড কেনার প্রত্যাশায়, সমস্ত দোকান খুঁজে কোথাও ব্লেড পেলেন না। শেষে এক দোকানে তিন-চার বছরের পুরোনো একটা জংধরা ব্লেড পেলেন। দোকানদার বলল, বিদেশ থেকে এইসব জিনিস আমরা আনি না। এমনিতেই আমাদের দাঁড়ি কম, যে দু'চারটে ছাগলি দাঁড়ি আছে তা আমরা নিজেদের দেশে তৈরি ক্ষুর দিয়েই শেভ করি। আমরা বিদেশকে কেন টাকা দিব? পাঠক লক্ষ্য করে দেখেন সেই দোকানদার এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথার ধরণ সেম সেম। ট্রাম্প বলেছেন, কানাডা এবং মেক্সিকো তাদের তৈরি জিনিস বিক্রি করে আমাদেরকে এতদিন শোষণ করেছে, এখন এর একটা বিহিত করা দরকার। বঙ্গবন্ধুর ব্লেড কেনার অভিজ্ঞতার অনেক বড় একটা তাৎপর্য আছে- সেটি হলো দেশে ব্যবহৃত জিনিস দেশেই তৈরি হবে- শুধু তাই নয় সমাজতান্ত্রিক দেশের ধারা অনুযায়ী সেগুলো রাস্ট্রই তৈরি করবে। তাইতো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি পাকিস্তানি ব্যবসায়ির ফেলে রাখা ৭২৫ টি কলকারখানার বড়গুলোকে রাস্ট্রায়াত্ব করে ফেললেন- এবং তারপর সেখানে আওয়ামীলীগের লোকদের যে মাৎস্যন্যায়- সেটি নিয়ে না'হয় আরেকদিন লিখব।
মোটকথা, দেশের জিনিস দেশেই তৈরি করব বলে যে একধরণের অবুঝ জাতীয়তাবাদের চেতনা - তা মুলত বাজে কথা। বরং অন্য দেশের জন্যও আমরা পণ্য তৈরি করব বললে বিষয়টি যথাযথ হয়। সাপ্লাই-ডিমান্ড যেমন ন্যাচারাল, বৈশ্বিক সাপ্লাই-চেইন তেমনি ন্যাচারাল- অর্থ্যাৎ মুক্ত বাজার অর্থনীতি। এটাই শেষ কথা হওয়া উচিত। যে চিন ঘুরে এসে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন তাদের সমাজতান্ত্রিকতা দেখে, যে চিনকে ধ্যানে- জ্ঞ্যানে-হৃদয়ে ধারণ করে মাওলানা ভাসানী বড় কিছু করতে চেয়েও পারলেন না, সেই চিন কিন্তু সত্তরের দশক থেকেই মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে যাব যাব করছিল, এবং যখন গেল তখনই তরতর করে উন্নতির শিখরে অবতরণ করতে শুরু করল। ভারতের দিকে তাকান, এমনকি বাংলাদেশে, কোন দেশে নয় ? নব্বুই দশকের পর থেকে বাজার যখন উন্মুক্ত হল- দেশগুলো উন্নতি সাধন করতে থাকল।
যে ট্রাম্প এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির কফিনে প্রথম পেরেক মারতে চাইছেন- তাদের একজন ফাউন্ডিং ফাদার- তাদের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন - প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে খুব যত্ন করে একটি বই পড়েছিলেন- এডাম স্মিথের 'ওয়েলথ অফ নেশন'- বইটি মুক্তবাজার অর্থনীতির আকরগ্রন্থ। অথচ আজ দুশো বছর পরে এসে নিজের পণ্য নিজের দেশেই উৎপন্ন করব বলা ট্রাম্পের, ট্যারিফ ইমপোজ করার ট্রাম্পের, আসল উদ্দেশ্যখানা হয়ত আমরা এখন বুঝতে পারছি না, তবে শীঘ্র পারব।
ক্যালগেরি
৩/২/২০২৫ ইং
All reactions:
Md Mostaba Ali, Wahedul Islam Patowary Raju and 19 others
4 comments
1 share
Like
Comment
Send
Share