একুশের বইমেলা সম্বন্ধে সবসময়ই আমার একটু দুর্বলতা ছিল। সেটা যে পুরোটা বইয়ের জন্য তা নয়, দোকানগুলো সৃজনশীল, দোকানিরা পরিচ্ছন্ন, ক্রেতারাও রুচিশীল। মেলার বাইরে পোড়া ভুট্টা, চটপটি (যদিও কোনসময়ই আমার পছন্দ নয়), কতকিছুর বিপণী। হুমাউন আহমেদ বিকাল থেকে বসতেন অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে। অটোগ্রাফ নেবার লম্বা লাইন পড়ত সামনে। হুমাউন আজাদ পুরোটা সময় বসে থাকতেন একটা স্টলে, নাম ভুলে গেছি, হাতে সিগারেট থাকত সব সময়। কোন এক সময় মেলার কোনদিকে হট্টগোল শোনা গেলে বোঝা যেত তসলিমা নাসরিনের উপর আত্রমণ হয়েছে কোথাও।
আমি নব্বই দশকের কথা বলছি। মেলার খুব কাছেই থাকতাম, বুয়েটের আহসানুল্লাহ হলে, মেলা যেতে রিক্সাভাড়া লাগত পাঁচ টাকা, চাইলে হেটেও যাওয়া যেত।
মেলার একটা জিনিস আমার ভাল লাগত, বিভিন্ন স্টলে বিশ্ববিদ্যলয়/কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা একমাসের জন্য চাকরি পেত। পার্ট-টাইম চাকরি। আমাদের দেশে হতভাগা ছাত্র-ছাত্রীদের পার্ট-টাইম জব বলতে শুধুই টিউশনি বোঝায়। অথচ যেকোনো অফিস-আদালতে তাদের পার্ট-টাইম চাকরি হওয়ার কথা। বিদেশে তো তাই হয়। অফিসগুলো ছোট বাচ্চাদেরকেও কাজ করতে দেয়, বিশেষ করে সামারে। তা ছাড়া রেস্টুরেন্টেও কাজ করা যায়। আমাদের দেশে সেই কালচার আর হল না। কোন ছাত্র রেস্তোরাঁয় ক্যাশে বসলে সমাজ তাকে নিয়ে টিটকেরি করবে। এই বিষয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ল। দিন তারিখ মনে নেই যদিও। প্রেসক্লাবের সামনে একটি রেস্টুরেন্ট, ভাত খেতেই মানুষ আসে বেশি। কোন এক দিন সেখানে গিয়ে দেখি, ক্যাশে বসে আছে আমারই এক স্কুল ফ্রেন্ড, নাম বলছি না যদি সে বিব্রত হয়। আমার সাথে সে সহজাত আচরণ করল। ছেলেটি ঢাকায় এসে স্ট্রাগল করছে। টিউশনি করাত কিনা জানি না, এই হোটেলে চাকরি করছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি, পড়াশুনা এবং থাকাখাওয়ার যোগান দেয়ার জন্য। এটুকু বলতে পারি, বুয়েট থেকে বেড়িয়ে যখন চাকরি নিলাম, আমরা যে বেতন পেতাম তা বাজারে খারাপ ছিল না, তবে আমার সেই বন্ধুটি সেইসময় আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বেতনে চাকরি করত। এইটাই মাঠের গল্প, বই থেকে পাওয়া নয়।
বই ও মাঠের গল্পে অনেক ফারাক থাকে। মাঠের ঘটনাগুলোকে বইয়ে স্থান দেয়া যায় না, দেয়া হয় না। অথবা দেয়ার ক্ষমতা লেখকদের নেই। আমাদের লেখকরা মধ্যবিত্তদের নিয়েই শুধু লিখতে পারে। উচ্চবিত্তেরের বৃত্তে তারা ঢুকতে পারে না, আবার নিম্নমধ্যবিত্তকে নিজেরাই ছোটলোক মনে করে। তাইতো মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত লেখা আমরা পাইনা। আমাদের লেখক/শিক্ষক/প্রবন্ধকার সবই চাটুকার বনে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আটহাজার বই লিখা হয়, অথচ তার বাড়ি ভাঙ্গার সময় একজনকেও প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না মাঠে। ওই যে বললাম, মাঠ আর বইয়ের রাজ্যের পার্থক্যের কথা। মাঠে গল্প তৈরি হয়, সেই গল্প মিস করে ফেলে আমাদের লেখকরা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত গল্প লেখা হয়েছে? হাজার হাজার তো হবেই, এইসব লেখকের অধিকাংশ দেশে ছিল না সেইসময়, ছিল কোলকাতায়, যুদ্ধের পর ফিরে এসে আরাম কেদারায় বসে, গরম কফির মগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা গল্প লিখেছে।
অথচ মাঠেই চরিত্র ঘোরাফেরা করে, আসল চরিত্র, যে লেখে সেও হয়তবা মাঠের একটা চরিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাশিয়ার যত যুগান্তকারী উপন্যাস লেখা হয়েছে তা লিখেছে যুদ্ধ করা সৈনিকরা। কিছুদিন আগে বদরুদ্দীন ওমরের লেখা 'আমার জীবন' বই পড়ছিলাম। কয়েকটি খণ্ডে। এক জায়গায় লেখা আছে, উনি যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, গ্রামে যেতেন মাঝেমধ্যে, থাকতেন কৃষকদের বাড়িতে। একবার কোনো এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতে, কিশোরগঞ্জের কোথাও। তার সাথে একজন সহযাত্রী ছিল, আপনারা চিনবেন, মুরগি কবির। শাহরিয়ার কবির যে বালিশটা নিয়েছিলেন সেটায় ছিল কৃষকের ঘামের বোটকা গন্ধ। তার ঘুম আসছিল না। ধান্দায় ছিল বদরুদ্দিন ওমর সাহেবের বালিশটা যদি হাতিয়ে নিতে পারেন। একসময় প্রকৃতির ছোট চাপে বদরুদ্দিন ওমরা সাহেব বাইরে গেলেন। এই সুযোগে শাহরিয়ার কবির দ্রুত বালিশটি বদলিয়ে ফেললেন। ওমর সাহেব সেটা টের পেয়েছিলেন, কিন্তু ভদ্রতা করে বলেন নি, তবে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন এই কবিরকে দিয়ে জাতির কিছুই হবে না।
উপরের গল্পটি বললাম কবিরকে ছোট করার জন্য নয়। বললাম আগেকার লেখকরা গ্রামে যেত, বদরুদ্দিন ওমরের বইয়ে এরকম আরও ঘটনা লেখা আছে। আমাদের আরেকজন লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, খোয়াবনামা লেখার সময় গ্রামে গিয়ে থেকেছেন। মানিক বন্দোপাধ্যায় পদ্মা নদীর মাঝি লেখার সময় জেলে বস্তিতে গিয়ে ছিলেন।
মাঠের গল্প লিখতে গেলে মাঠে যেতে হবে, অথবা হতে হবে মাঠের সন্তান। আমাদের মাঠের সন্তান তো কৃষক, তারা তো পড়তেই জানে না, সই বলতে টিপসই। জিয়ার আমলে এইসব মূর্খ লোকদের আলোকিত করার জন্য নৈশ ইস্কুল ছিল। আমাদের বাড়ির পাশেই রাতে এক হিন্দুবাড়ির উঠোনে স্কুল বসত। তারপর কবেই সেইসব চুকেবুকে গেছে। অশিক্ষিতরা আরো অশিক্ষিত হচ্ছে। কারা লিখবে বই?
যারা প্রবন্ধ লেখে তারা চেতনায় বলীয়ান হয়েই লেখে, চেতনাই তাদের একমাত্র সম্বল। যারা উপন্যাস লেখে, সেই আমি-তুমি-সে। হুমাউন আহমদে আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ছোট কিশোরীরা কীভাবে বুড়োদের প্রেমে পড়বে। যে 'দেয়াল' নিয়ে আপনারা এত মাতামাতি করেন, সেই দেয়ালের দুটো মেইন চরিত্র অবন্তি- সেখানে পুরো শাওনের ছায়া দেখবেন, দাদা চরিত্র সরফরাজ খানের মধ্যে পুরো চ্যালেঞ্জারকে খুঁজে পাবেন। শেষ জীবনে হুমায়ূন যত লিখেছেন সবকিছুতেই শাওন ঘুরপাক খেয়েছে। লেখক হিসাবে এভাবেই তার অধঃপতন ঘটেছে। ভাল লেখক বলতে এখন নেই, হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও বইমেলা চলবে, লোকে একুশে পদক পাবে। দেখা যাক একদিন যদি ভাল সময় আসে।
ক্যালগেরি
ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫ ইং