(ভ্রমণ)
আমাদের গাড়ির তেল শেষ হয়ে যাচ্ছিল। বানফ্ শহরের আগে একটা তেলের পাম্প পেয়েও অবহেলা করেছি। ভেবেছিলাম হাইওয়ের পাশে পরে অবশ্যই তেলের পাম্প পাবো। বানফ্ শহর পার হয়ে যাবার পরে আমরা যখন ডানে ঘুরে হাইওয়ে-১ থেকে সরে জেসপারের হাইওয়ে ধরলাম তখন থেকেই ঘন অরণ্য শুরু হয়ে হলো। একটু পরে ফোনের নেটওয়ার্ক চলে গেল। আমি একই সাথে খুশি হলাম এবং ভয় পেলাম। খুশি হলাম এইজন্য যে কেউ ফোনে বিরক্ত করবে না, আর ভয় পেলাম যদি গাড়ির তেল হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায় তাহলে ফোন করে কারও সাহায্য চাইতে পাবো না। আমার সিএএ এর মেম্বারশিপ করা আছে, এইজন্য বছরে ১০০ ডলারের মতো গুনতে হয়। ওদের সাথে চুক্তি আছে রাস্তায় যেকোনো ধরনের বিপদ হলে ওরা এসে উদ্ধার করবে। শর্ত হলো বছরে তিনবারের বেশি ডাকতে পারবো না। তিনবারের বেশি হলেও সাহায্য করবে, তবে গলা কাটবে। কাজেই আমাকে হিসেব করে চলতে হয় যাতে বছরে তিনবারের বেশি বিপদে না পড়ি। চলতি পথে যেকোন বিপদ হলে এদের সাহায্য করার কথা। বরফে গাড়ি আটকে গেলে আগে কয়েকবার এদের সাহায্য নিয়েছি, সার্ভিস ভালো, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে উদ্ধার করে দিয়ে যায়।
কখনো ভাবিনি কানাডার কোনো হাইওয়েতে ফোনের নেটওয়ার্কে টানাটুনি পড়বে। ফোনে গুগল ম্যাপ সেট করা ছিল। নেটওয়ার্ক না থাকার ফলেও কীভাবে যেন এটি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, ম্যাপ নামের অ্যাপটি ওভারস্মার্ট হয়েছে কিনা কে জানে? তবে থোরা গড়বড় হয়েছেই, মাঝেমাঝেই ইউ-টার্ন নিয়ে ভাটির দিকে চলে যেতে বলছে। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই জেনেও নিয়ারেস্ট গ্যাস স্টেশন বলে সার্চ দিলাম। ম্যাপ উত্তরে বলল চারশো কিলোমিটার পরে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ছোট্ট এক শহরে একটি গ্যাস স্টেশন পাওয়া যাচ্ছে। বউকে বললাম তুমি বরং রাস্তার আশেপাশের সাইন গুলা লক্ষ্য করো, সামনে সার্ভিস-টাউন থাকলে সাধারণত সাইনবোর্ড দিয়ে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হয়।
হাইওয়ে গিলতে গিলতে আমার গাড়ি এগিয়ে চলছে। কোনো ছোট শহরের হদিস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে চেপে ভাবিনি এটাতো পাহাড়, এখানে হঠাৎ করে সার্ভিস শহর কোত্থেকে আসবে?
গাড়ির যেমন তেলের তেষ্টা পেয়েছে, আমার পেয়েছে কফির তেষ্টা। আমি যখন হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করি সবসময় এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে থাকি। আরেক হাতে ধরা থাকে কফির কাপ। কফি নেই তাই দুই হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছি। দুই হাত দিয়ে চালাতে বড় কষ্ট হচ্ছে। গাড়ি মাঝে মাঝেই ডানে বামে টাল খেতে চাচ্ছে।
আগেই বলেছি রাস্তার দুধারে গভীর সবুজ অরণ্য। সেখানে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, একেবারে বিরান। হরিণ ভাল্লুক দূরে থাক, একটা পাখি বা ফরিঙও দেখতে পেলাম না। এরা সম্ভবত মানব সভ্যতার সাথে গোসা করেছে। যেহেতু অরণ্য, অবশ্যই লাখে লাখে প্রাণী আছে, রাগ করে মানুষকে মুখ দেখাতে চাচ্ছে না এই যা। গাছরা যেহেতু নড়তে পারে না, বাধ্যহয়ে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দুই ধারে। ক্ষমতা থাকলে এরাও মানুষের কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যেতো।
এখানে কিছুদুর পরপর রাস্তার নিচ দিয়ে পশু পারাপারের টানেল রয়েছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছে গাড়ির নিচে পিষে যাবার ভয়ে বন্য প্রাণিকূল রাস্তার একপাশের জঙ্গল থেকে আরেক পাশের জঙ্গলে যেতে চাইছে না। মেটিং সিজনে দেখা গেল নারী প্রাণীরা রাস্তার একধারে, পুরুষ প্রাণীরা রাস্তার আরেক ধারে বসে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। বিজ্ঞানীরা অংক কষে দেখলেন, এদের যদি ওই বিশেষ কাজটি করতে না দেয়া হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এরা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। অতএব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো রাস্তার নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করা হবে শুধুমাত্র পশু পারাপারের জন্য। লাখ লাখ ডলার খরচ করে অনেক টানেল তৈরি করা হলো। প্রথম যে টানেলটি তৈরি করা হয়েছিল, উদ্ভোধনের দিন থেকেই খাতা-কলম নিয়ে বসা হলো প্রতিদিন কত হাজার প্রাণী পারাপার করে সেটা দেখার জন্য। বাস্তবে দেখা গেল ভুলেও কোন প্রাণী টানেলের কাছাকাছি আসছে না। যদিওবা কেউ আসছে তাদের চোখে সন্দেহের দোলা। ভাবছে টানেল এর মধ্যে না জানি কী মৃত্যুকূপ বানিয়ে রেখেছে মরার মানুষেরা। একটি প্রাণীও টানেলের ভিতর মাথা ঢুকায় নি। এভাবে এক বছর গড়িয়ে যায়, অবশেষে এক গভীর রাতে একটি ভাল্লুক অনেক দোনোমোনো করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টানেল পার হয়। আমার ধারণা তার যে এই সৎসাহস হয়েছিল সেটা সেই বিশেষ কাজটি করার তারণা থেকে। হয়তো তার বান্ধবী রাস্তার আরেকদিকে থাকতো। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বানের জলের মতো পশুরা টানেল পারাপার করেছে আর বলেছে এক বছর ধরে কী ভুলটাই না করেছি।
আগেভাগে কোন সাইন না দিয়েই হঠাৎ করে যেন মাটি ফুঁড়ে একটা গ্যাস স্টেশন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। গ্যাসস্টেশন পার করে আমি কিছুটা উজিয়ে গিয়েছিলাম, পরে ফেরত এসে প্রাণভরে গ্যাস নিলাম। একটু আগে জঙ্গলের মধ্যে প্রকৃতির ডাক সেরেছি ভেবে লজ্জা পেলাম।এখানে কতো ভালো রেস্টুরেন্ট ছিল।
No comments:
Post a Comment