Sunday, October 24, 2021

অক্টোবর স্কেচ

 (স্কেচ)

যদিও ভাল পারিনা , আঁকার চেষ্ট করি। আমার ছবিতে কোন রং নেই, তুলি নেই, স্রেফ একটা কলম হাতে। এই দিয়েই চেষ্টা করি। 








পাহাড়ি ঝরনা-৩

(ভ্রমণ)

আমাদের গাড়ির তেল শেষ হয়ে যাচ্ছিল। বানফ্ শহরের আগে একটা তেলের পাম্প পেয়েও অবহেলা করেছি। ভেবেছিলাম হাইওয়ের পাশে পরে অবশ্যই তেলের পাম্প পাবো। বানফ্ শহর পার হয়ে যাবার পরে আমরা যখন ডানে ঘুরে হাইওয়ে-১ থেকে সরে জেসপারের হাইওয়ে ধরলাম তখন থেকেই ঘন অরণ্য শুরু হয়ে হলো। একটু পরে ফোনের নেটওয়ার্ক চলে গেল। আমি একই সাথে খুশি হলাম এবং ভয় পেলাম। খুশি হলাম এইজন্য যে কেউ ফোনে বিরক্ত করবে না, আর ভয় পেলাম যদি গাড়ির তেল হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায় তাহলে ফোন করে কারও সাহায্য চাইতে পাবো না। আমার সিএএ এর মেম্বারশিপ করা আছে, এইজন্য বছরে ১০০ ডলারের মতো গুনতে হয়। ওদের সাথে চুক্তি আছে রাস্তায় যেকোনো ধরনের বিপদ হলে ওরা এসে উদ্ধার করবে। শর্ত হলো বছরে তিনবারের বেশি ডাকতে পারবো না। তিনবারের বেশি হলেও সাহায্য করবে, তবে গলা কাটবে। কাজেই আমাকে হিসেব করে চলতে হয় যাতে বছরে তিনবারের বেশি বিপদে না পড়ি। চলতি পথে যেকোন বিপদ হলে এদের সাহায্য করার কথা। বরফে গাড়ি আটকে গেলে আগে কয়েকবার এদের সাহায্য নিয়েছি, সার্ভিস ভালো, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে উদ্ধার করে দিয়ে যায়।
কখনো ভাবিনি কানাডার কোনো হাইওয়েতে ফোনের নেটওয়ার্কে টানাটুনি পড়বে। ফোনে গুগল ম্যাপ সেট করা ছিল। নেটওয়ার্ক না থাকার ফলেও কীভাবে যেন এটি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, ম্যাপ নামের অ্যাপটি ওভারস্মার্ট হয়েছে কিনা কে জানে? তবে থোরা গড়বড় হয়েছেই, মাঝেমাঝেই ইউ-টার্ন নিয়ে ভাটির দিকে চলে যেতে বলছে। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই জেনেও নিয়ারেস্ট গ্যাস স্টেশন বলে সার্চ দিলাম। ম্যাপ উত্তরে বলল চারশো কিলোমিটার পরে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ছোট্ট এক শহরে একটি গ্যাস স্টেশন পাওয়া যাচ্ছে। বউকে বললাম তুমি বরং রাস্তার আশেপাশের সাইন গুলা লক্ষ্য করো, সামনে সার্ভিস-টাউন থাকলে সাধারণত সাইনবোর্ড দিয়ে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হয়।
হাইওয়ে গিলতে গিলতে আমার গাড়ি এগিয়ে চলছে। কোনো ছোট শহরের হদিস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে চেপে ভাবিনি এটাতো পাহাড়, এখানে হঠাৎ করে সার্ভিস শহর কোত্থেকে আসবে?
গাড়ির যেমন তেলের তেষ্টা পেয়েছে, আমার পেয়েছে কফির তেষ্টা। আমি যখন হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করি সবসময় এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে থাকি। আরেক হাতে ধরা থাকে কফির কাপ। কফি নেই তাই দুই হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছি। দুই হাত দিয়ে চালাতে বড় কষ্ট হচ্ছে। গাড়ি মাঝে মাঝেই ডানে বামে টাল খেতে চাচ্ছে।
আগেই বলেছি রাস্তার দুধারে গভীর সবুজ অরণ্য। সেখানে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, একেবারে বিরান। হরিণ ভাল্লুক দূরে থাক, একটা পাখি বা ফরিঙও দেখতে পেলাম না। এরা সম্ভবত মানব সভ্যতার সাথে গোসা করেছে। যেহেতু অরণ্য, অবশ্যই লাখে লাখে প্রাণী আছে, রাগ করে মানুষকে মুখ দেখাতে চাচ্ছে না এই যা। গাছরা যেহেতু নড়তে পারে না, বাধ্যহয়ে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দুই ধারে। ক্ষমতা থাকলে এরাও মানুষের কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যেতো।
এখানে কিছুদুর পরপর রাস্তার নিচ দিয়ে পশু পারাপারের টানেল রয়েছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছে গাড়ির নিচে পিষে যাবার ভয়ে বন্য প্রাণিকূল রাস্তার একপাশের জঙ্গল থেকে আরেক পাশের জঙ্গলে যেতে চাইছে না। মেটিং সিজনে দেখা গেল নারী প্রাণীরা রাস্তার একধারে, পুরুষ প্রাণীরা রাস্তার আরেক ধারে বসে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। বিজ্ঞানীরা অংক কষে দেখলেন, এদের যদি ওই বিশেষ কাজটি করতে না দেয়া হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এরা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। অতএব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো রাস্তার নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করা হবে শুধুমাত্র পশু পারাপারের জন্য। লাখ লাখ ডলার খরচ করে অনেক টানেল তৈরি করা হলো। প্রথম যে টানেলটি তৈরি করা হয়েছিল, উদ্ভোধনের দিন থেকেই খাতা-কলম নিয়ে বসা হলো প্রতিদিন কত হাজার প্রাণী পারাপার করে সেটা দেখার জন্য। বাস্তবে দেখা গেল ভুলেও কোন প্রাণী টানেলের কাছাকাছি আসছে না। যদিওবা কেউ আসছে তাদের চোখে সন্দেহের দোলা। ভাবছে টানেল এর মধ্যে না জানি কী মৃত্যুকূপ বানিয়ে রেখেছে মরার মানুষেরা। একটি প্রাণীও টানেলের ভিতর মাথা ঢুকায় নি। এভাবে এক বছর গড়িয়ে যায়, অবশেষে এক গভীর রাতে একটি ভাল্লুক অনেক দোনোমোনো করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টানেল পার হয়। আমার ধারণা তার যে এই সৎসাহস হয়েছিল সেটা সেই বিশেষ কাজটি করার তারণা থেকে। হয়তো তার বান্ধবী রাস্তার আরেকদিকে থাকতো। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বানের জলের মতো পশুরা টানেল পারাপার করেছে আর বলেছে এক বছর ধরে কী ভুলটাই না করেছি।
আগেভাগে কোন সাইন না দিয়েই হঠাৎ করে যেন মাটি ফুঁড়ে একটা গ্যাস স্টেশন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। গ্যাসস্টেশন পার করে আমি কিছুটা উজিয়ে গিয়েছিলাম, পরে ফেরত এসে প্রাণভরে গ্যাস নিলাম। একটু আগে জঙ্গলের মধ্যে প্রকৃতির ডাক সেরেছি ভেবে লজ্জা পেলাম।এখানে কতো ভালো রেস্টুরেন্ট ছিল।

পাহাড়ি ঝর্ণা - ২

(ভ্রমণ)

বিশ বছর আগে রাজু নামের এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ছেলেটি ছিল গ্যাংটকের একটি হোটেলের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। আসামের ছেলে। আসামের এক-তৃতীয়ংশ মানুষ বাংলা বলে, রাজু তারমধ্যে পড়েছে। কাজেই আলাপ-পরিচয় হয়ে উঠল। রাত দশটার পরে সব ট্যুরিস্ট বিছানায় কুপোকাৎ। রাজু তখন আমার রুমে আসতো গল্প করতে। জানতে পারলাম ছেলেটি ছোটবেলায় আসামের জঙ্গল থেকে গ্রেট হিমালয়ের দিকে ধ্যানমগ্নের মতো তাকিয়ে থাকতো, ভাবতো একদিন ওখানে চলে যাবে। পাহাড় ওকে টানতো। আমি রাজুর সাথে আমার মিল খুঁজে পেলাম। শরৎকাল আমাদের বাড়ি থেকে হিমালয় দেখা যেত, স্পষ্ট নয়, তবে ইগনোরও করা যেত না । রাজুর মতো আমিও পাহাড় দেখে উদাসী হতাম। তবে ওর মতো পাহাড়ের কাছে গিয়ে সারাজীবনের জন্য আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা কখনো জাগেনি। ঠিক করে রেখেছিলাম হাতে পয়সা এলে হিমালয়ে যাবো। সেটা গিয়েছি।
হিমালয় দেখেছি, আল্পস দেখেছি, রকি দেখেছি। এছাড়া খুচরা কত যে পাহাড় দেখেছি। পাহাড়কে নিয়ে আমার আদিখ্যেতা এখনও বহাল আছে। পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে থাকে ঘন অরণ্য। আরণ্যকে মেলারকম শব্দের উৎপত্তি হয়। কখনো পাহাড়ি ঝিঁঝিঁপোকা, কখনও ভল্লুকের শুকনো পাতা মাড়ানো, কখনও বয়ে চলা ঝর্ণার শব্দ, এবং অবশ্যই পাহাড়ি নদীর শব্দ। পাহাড়ের অন্তর্গত সৌন্দর্য পরিপূর্ণ করার জন্য একটা নদীর উপস্থিতি জরুরী হয়ে পড়ে। সেরকম একটা নদী আমাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ থেকেই লুকোচুরি খেলছে। কখনও হাইওয়ের একেবারে কাছে এসে পড়ে, কখনও অরণ্যকে সামনে ঠেলে দিয়ে কোথায় যেন কেটে পড়ে।
একবার কফি-ব্রেকে সালাহউদ্দিন ভাই রেগে গেলেন। বললেন পাশে এত সুন্দর একটা নদী বয়ে চলছে আর তুমি একবারও থামলে না? আমি বললাম সামনে নিশ্চয়ই থামার জায়গা পাবো।
আমরা গাড়ি চালাচ্ছি,নদী আমাদের সাথেই আছে। নদীটি টাটকা,মনে হবে এখনি ওভেন থেকে নামানো হয়েছে। ওর পানির রং ডাবের পানির মতো ঘোলাটে-সাদা।
আমার স্ত্রী একসময় বলল যদি নদীর পানি স্পর্শ করতে পারতো। এইবার আমি সিরিয়াস হলাম। বৌয়ের এই আবদার আমার একদম সামর্থ্যের মধ্যে।

পাহাড়ি ঝর্ণা -১

(ভ্রমণ)

রকি পাহাড়ে অনেক দৃষ্টিনন্দন লেক আছে। কিছু লেক বিখ্যাত, সবাই দেখতে যায়, কিছু অখ্যাত। ছবির এই লেকটি অখ্যাত, কালেভদ্রে কেউ এখানে বেড়াতে আসে। জায়গাটি অমানবিক রকম নির্জন। এর একটা ভৌতিক কারণ আছে বলে আমি মনে করি। কেন এমন মনে করছি সেটা পোস্টের শেষে থাকবে।
নির্জনতার জন্য সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী এই লেকটাকে পছন্দ করে। তাই এর নাম হানিমুন লেক। আশেপাশে হোটেল বা কটেজ কিছুই নেই। এখানে যারা কয়েকদিনের জন্য আসে তারা সঙ্গে তাবু বা ক্যাম্পার নিয়ে আসে।
নিচের ছবিটি ২০০৯ সালে তোলা, বৌসহ এসেছিলাম। তখন আমাদের বিয়ের বয়স পাঁচ , তাই হানিমুন কোটায় পড়ি নাই। এরকম চমৎকার একটি জায়গায় দুজনে একসাথে একটি ছবিও তুলতে পারিনি। কারণ হচ্ছে - তখন সেলফি ক্যামেরা ছিল না। এই ছবিটি সনি সাইবারশট নামে এক ক্যামেরা দিয়ে তোলা। বৌ আমার ছবি তুলে দিয়েছে, আমিও তারটা তুলেছি ,ভাইস-ভারসা। আশেপাশে লোকজন থাকলে তাদেরকে রিকোয়েস্ট করতাম, কিন্তু কেউ ছিল না, যে একজন ছিল সে নিশ্চয়ই আমাদের মতো রক্ত মাংসের কেউ নয়। ভুতের বিষয়টায় পরে আসছি। স্টে-টিউনড।
২০০৯ সালে আমাদের সন্তান ছিলনা। এখন দুজন রাজকন্যা আছে। উপরের ছবিটিতে তাদেরকে দেখছেন। এই ছবিটি কয়েকদিন আগের তোলা।
দুটো ছবিতে কোন পার্থক্য দেখছেন? উপরে তাকিয়ে দেখুন, আগের ছবিতে পাহাড়ের চূড়ায় বরফ ছিল, একযুগের ব্যবধানে সেই বরফ হাপিস হয়ে গেছে। একেই বলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বিষয়টা কত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে মশাই ভাবতে পারেন?এখনো সময় আছে গাছটাছ লাগান, কম করে তেল পোড়ান। ইউরোপকে দেখে শিক্ষা নিন। ওরা যেভাবে সবুজ হচ্ছে সেটা হিংসে করার মতো।
এবার ভৌতিক ব্যাপারটায় আসি। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার সামনেই একটি ঘাট আছে। সেখানে একটা খেয়া নৌকা বাঁধা থাকে। কাঠের লগ দিয়ে একটা লম্বা ডেক করা হয়েছে। সেই ডেকের মাথায় ২০০৯ সালে একটি নারীকে বসে থাকতে দেখেছিলাম। একেবারে অনড়, মনে হচ্ছিল যেন মূর্তি। সোনালি চুলের এক তরুণী। মেয়েটির সাথে কোন ছেলেবন্ধু ছিল না। সে ছিল একদম একা। বাড়ি থেকে গণ্ডগোল করে এসেছে কিনা কে জানে? যদি পানিতে ঝাপ দেয়?সেইবার মেয়েটির খুব কাছে গিয়ে গলা খাকারি দিয়েছিলাম তার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য, যদি একটা ছবি তুলে দেয়। কিন্তু সেই নারী পিছন ফিরে তাকায়নি। একটুও নড়েনি। আমার কেমন যেন একটু গা শিওরে উঠেছিল। কী কারণে জানিনা।
এইবার বারো বছর পরে হাইওয়ে দিয়ে যাবার সময় গাছের পাতার আড়ালে ছোট একটা সাইন দেখলাম- হানিমুন লেক। একটা সরু পাহাড়ি রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে হাড়িয়ে গেছে। আমি সাইনটি পার হয়ে গিয়ে কী মনে করে গাড়ি থামালাম। সালাহউদ্দিন ভাই আমাকে ফলো করছিলেন। উনিও ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলেন। আমি ইউটার্ন নিয়ে সেই সরু রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। আগেকার অনেক স্মৃতি মনে পড়ল। আমার স্ত্রী বলল, কী আশ্চর্য ব্যাপার সেই হানিমুন লেক?
সেইবার সন্ধ্যা ছিল। আজকেও তাই, চারপাশে টোয়াইলাইটের আলো। আমি গাড়ি থেকে নেমেই থমকে দাঁড়ালাম। একই যায়গায় একই ভঙ্গিমায় সেই নারীমূর্তি। সোনালি চুলের তরুণী। সালাহউদ্দিন ভাইকে বিষয়টা বলায় উনি বললেন, বিষয়টা তো ভৌতিক। চলো আমরা আর ওদিকে না যাই, কী দরকার ?
আমি আধিভৌতিক কিছুই বিশ্বাস করি না। তবুও আমার মনটা খচখচ করে উঠলো।