একটি বুলেটের পেটের ভেতর অনেকগুলি ছোট ছোট বুলেট, দশটা থেকে একশোটা হতে পারে। এরকম তিনটা গুলি পরপর ছোড়া হলে তিনিশো ছোট বুলেটে বিদ্ধ হতে পারে যেকেউ। হয়েছেও সেরকম ঘটনা। বগুড়ার শেরপুরের মজিদের গায়ে তিনশোটি গুলি লেগেছে। এই ধরণের ক্ষুদে গুলিকে ছররা গুলি বা পেলেট বলা হয়। বর্তমানের অস্থির পৃথিবীতে দিন দিন এর ব্যবহার বাড়ছে এবং সেখানে বাংলাদেশ অবশ্যই এক ধাপ আগিয়ে আছে (ছিল)। আমাদের পতিত দেশরত্ন শেখ হাসিনার অন্যতম প্রিয় অস্ত্র ছিল এই ছররা গুলি।
বিক্ষোভের দিনগুলোতে আপনারা অনেকের পিঠের দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছেন। শুধু পিঠ নয় ওদের বুকও ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়। প্রথমে বুকেই এসে লাগে বুলেটগুলো, পরে পিছন ফিরে দৌড়ানোর সময় আরো বেশি পরিমাণ ছররা গুলি আঘাত করে পিঠে। মজিদ ছাড়াও অসংখ্য ভিকটিম রয়েছে। ১৮ জুলাই রামপুরায় জসিমের চোখে লাগে ছররা গুলি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মামুনের বুকে ছররাগুলি আঘাত হানে ১৫ জুলাই। সে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনন্য মজুমদার ছররা গুলিবিদ্ধ হয় ১১ই জুলাই। ১৬ই জুলাই নরসিংদীতে ছররা গুলিবিদ্ধ হয় কিশোর রিয়াদ। স্কুল ছাত্র সামীরের দুটো চোখে ছররা গুলির আঘাত লাগে ১৮ই জুলাই। ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রাস্তা পার হতে গিয়ে ছররা গুলিবিদ্ধ হয় দর্জি মো. শামসুদ্দিন। ২০ জুলাই বাড়ি ফেরার পথে ছররা গুলির কপটে পড়ে গার্মেন্ট কর্মী জাহিদ। কতজনের নাম বলবো? এরকম শত শত ছাত্র-জনতা রয়েছে যাদের বুক-পিঠ-চোখ বিদ্ধ হয়েছে ছররা গুলিতে। এদের কেউ সরাসরি বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছিল, কেউবা পথচারী, কেউবা এসেছিল ঠিক কি হয়েছে দেখতে। এদের কারো কারো পরিণতি হয় ভয়াবহ। দুটো বা একটি করে চোখ হারিয়েছে। বেশিরভাগের শরীর থেকে সবগুলো গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। শরীরের তীব্র ব্যথা নিয়ে অনেককে বেঁচে থাকতে হবে বাকি জীবন। এরা গুলি খেয়ে যখন বিভিন্ন হাসপাতালের দ্বারস্থ হয় অনেকেই তাদেরকে অ্যাডমিট করতে চাইনি। ঘুরেফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়েছে। ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা হাসপাতালেও হামলা করেছিল। আংশিক চিকিৎসা নিয়ে যারা ঘরে ফিরেছে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি। কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। সিভিল ড্রেস পরে কখন কোন বাহিনী চলে আসে বোঝা যায় না। কাউকে ডিবি অফিসে, কাউকে অজ্ঞাতনামা কোন স্থানে ধরে নিয়ে যায়। বুলেটবীদ্ধ হবার পরে সুচিকিৎসা তো দূরে থাক, জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে যুবকদের, কিশোরদের। গুলিবিদ্ধদের সবারই একটি করে ব্যক্তিগত স্টোরি রয়েছে, বড় করুন সেই স্টোরি, মাঝে মাঝে চোখে পড়ে, চোখ আদ্র হয়।
সাধারণত এয়ারগান/শটগান ব্যবহার করে এই ছররাগুলি ছোড়া হয়। ইঁদুর কিংবা কীটপতঙ্গ মারার জন্য এই গুলির ব্যবহার রয়েছে। ঠিক কবে থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকাহিনীর হাতে এই টেকনোলজি উঠে এলো তা সঠিক বলতে পারব না। ছররাগুলির প্রকারভেদ রয়েছে, প্লাস্টিক বা মেটাল যেকোনো কিছু হতে পারে। সাধারণত দুই ধরনের ক্যালিবারের হতে পারে, ৪.৫ অথবা ৫.৫ মিলিমিটারের। হাসিনা নিশ্চয়ই ভালো মানের গুলি ব্যবহার করেছে। এমনিতে ছররা গুলি লিথাল উইপন হিসাবে পরিগণিত হয় না। রাবার বুলেট গোত্রের, তবে ক্ষতি একটু বেশি করে। এর পাওয়ার সত্যিকার বুলেটের চেয়ে অনেকাংশে কম। সেক্ষেত্রে মারা যাওয়ার চান্স কম তবে চোখ এবং গলায় লাগলে আংশিক দৃষ্টিশক্তি হারানো থেকে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়া সম্ভব। সেটিই হয়েছে গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে।
স্বৈরাচারী দেশগুলোতে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করতে প্রাথমিক স্তরে ছররা গুলি ব্যবহার করা হয়। গণতন্ত্রের মুখোশধারী অথবা কাগজে-কলমে গণতন্ত্রের দেশগুলোতে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশে তো সব কিছুই গণতান্ত্রিক ছিল। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হত। আমাদের একটি সংবিধান ছিল। একটি সংসদ ভবন ছিল। মানব-পতাকা বানিয়ে আমরা গিনিস বুকে নাম লিখিয়েছিলাম। গোলাভরা গণতন্ত্র আর গোয়াল ভরা উন্নয়ন ছিল। সেই সাথে ভারতের আশীর্বাদ। হয়তো ভারত থেকেই আমরা এই ছররা গুলির আইডিয়া আমদানি করে এনেছি কেননা ভারত কাশ্মীরে ২০১০ এবং ২০১৬ সালে এর ব্যাপক প্রয়োগ করে বহুজনকে অন্ধ বানিয়েছে। ভারত ছাড়াও ২০১৯-২০ সালে হংকংয়ে সরকারবিরোধী যে প্রটেস্ট হয় সেটা ছত্রভঙ্গ করতেও ছাররা গুলি ব্যবহার করা হয়। ভেনেজুয়েলাতে ২০১৪ থেকে ২০ পর্যন্ত ছড়াগুলির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ইসরাইল গাঁজা উপত্যকা, পশ্চিম-তীর এবং পূর্ব-জেরুজালেমে নিয়মিতভাবে ছররা গুলি ব্যবহার করে থাকে। উন্নত দেশ যথা ফ্রান্স কিংবা আমেরিকা, সেখানেও সাম্প্রতিক সময়ে এই গুলির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক জায়গায় চোখ হারিয়েছেন অসংখ্য লোক।
আমি জানি না বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে অথবা পুলিশ কোডে ছররা গুলির ব্যবহার বৈধকরণ করা আছে কিনা। যদি থাকে সেখানে সংশোধন দরকার। যেহেতু এর বিকল্প আছে (জলকামান, রাবার বুলেট) সেহেতু এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। আর যদি এটি বাংলাদেশে বৈধ না হয় তবে পুলিশের হাতে কিভাবে এলো তার তদন্ত হওয়া উচিত। মোটকথা ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আমরা আর শতগুলিবিদ্ধ কোন পিঠ দেখতে চাইনা। আমাদের খারাপ লাগে।
ক্যালগেরি, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪